ডার্ক ট্যুরিজম, ভ্রমণের গন্তব্য যখন ট্র্যাজেডি
আবুল বাশার
কাঁধে ব্যাগ, মুঠোফোনে ম্যাপ, তারপর টিকিট কেটে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া- জগতটাকে এভাবে ঘুরে দেখার ইচ্ছা কার না আছে? ভ্রমণের গন্তব্যস্থল কল্পনা করতে বললে আপনার চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠবে নায়াগ্রা জলপ্রপাত, আইফেল টাওয়ার কিংবা মিশরের পিরামিড। দেশের ভেতরে হয়তো যাইতে চাইবেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কিংবা সাজেক ভ্যালি। শান্ত পাহাড়ের নিস্তব্ধতা থেকে সুবিশাল সমুদ্র, প্রাচীন নগরী থেকে প্রবাসের অলিগলি- পর্যটনের ক্ষেত্র সুবিস্তৃত। আনন্দ, জানার আগ্রহ ও ঘোরার শখ- এসব কিছু মিলিয়ে পর্যটন। কিন্তু সেই পর্যটনের স্থান যদি হয় এমন কোনো স্থান, যার ইতিহাস কেবল দুঃখ এবং দুর্দশায় ভরা, তাহলে? অথচ ট্যুরিজম বা পর্যটনের নানা প্রকারের মধ্যে রয়েছে এমনই একধরনের পর্যটনশিল্প, যা কি না ইতিহাসের শোক এবং কষ্টের অধ্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। নাম তার- ডার্ক ট্যুরিজম।
১৯৯৬ সালে ডার্ক ট্যুরিজম এর ধারণা প্রবর্তন করেন গøাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটির দুই ফ্যাকাল্টি সদস্য জন লেনন এবং ম্যালকম ফোলি। তাদের সংজ্ঞানুসারে, দুর্যোগ এবং ট্র্যাজেডির সাথে সম্পর্কিত স্থানে ভ্রমণ করাকে ডার্ক ট্যুরিজম বলে। কোনো স্থান অতীতের ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে থাকলে তার প্রতি মানুষের কৌতূহল এবং তা দর্শন করা ডার্ক ট্যুরিজমের অন্তর্গত। এই ভয়াবহতা হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা মানবসৃষ্ট কোনো ঘটনা। গোটা বিশ্ব জুড়ে রয়েছে ডার্ক ট্যুরিজমের অজস্র স্থান। নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের সাক্ষী পোল্যান্ডের অসউইৎজ ক্যাম্প, জাপানের আওকিগাহারা সুইসাইড ফরেস্ট, রুয়ান্ডার গণহত্যার মেমোরিয়াল, পারমাণবিক বোমায় হারিয়ে যাওয়া হিরোশিমা এবং নাগাসাকির ধ্বংসাবশেষ, ৯/১১ হামলার স্বাক্ষী গ্রাউন্ড জিরো- সবকটি স্থানের একটি ক্ষেত্রে মিল আছে, প্রতিটি স্থান মানুষের বেদনার স্বাক্ষী। ডার্ক ট্যুরিজম হতে পারে কোনো সিরিয়াল কিলার বা সন্ত্রাসীর একসময়ের আবাসস্থলে। মজার ব্যাপার হলো, ডার্ক ট্যুরিজমকে আকৃষ্ট করে নানা দেশে নানা ধরনের মিউজিয়াম বা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে। লস অ্যাঞ্জেলসের ‘মিউজিয়াম অফ ডেথ’ ডার্ক ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করার জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের নানা অপরাধীর কুকীর্তির কথা জানতে বহু দর্শনার্থী ঘুরে আসেন এই জাদুঘর। ডার্ক ট্যুরিজমের প্রসারের স্বার্থে বহু সংঘ এবং অনলাইন ওয়েবসাইট রয়েছে।
লেনন-ফোলির সংজ্ঞানুসারে, পম্পেই ডার্ক ট্যুরিজমের আওতায় না পড়লেও ভয়াবহতার দিক দিয়ে এটি কোনো অংশে কম নয়। আবার ভিসুভিয়াসও এখনো মরে যায়নি, ঘুমন্ত এই আগ্নেয়গিরি যেকোনো সময়ে আবারও জেগে উঠতে পারে। তাই ডার্ক ট্যুরিজমে পম্পেইকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতেই পারে। ডার্ক ট্যুরিজমকে কি খুব অদ্ভুত এবং অপরিচিত কোনো বিষয় মনে হচ্ছে? মজার ব্যাপার হলো, আমাদের বাংলাদেশেই ডার্ক ট্যুরিজমের বেশ কিছু স্পট রয়েছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে যে বৈশিষ্ট্য আমাদের অন্য সকল জীব থেকে আলাদা করে রেখেছে তা হলো আমাদের জানার আগ্রহ, কৌতূহল। আর শুধুমাত্র বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তো চলবে না, ভবিষ্যতের সঠিক পথ বোঝার জন্য আমাদের পেছন ফিরে তাকাতেই হবে। অতীতকে ভুলে কখনো ভবিষ্যতকে গড়া যাবে না। জাতি হিসেবেও আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের ইতিহাস না জানলে আমরা কখনো স্বাধীনতার মর্ম বুঝতে পারবো না। আর এ কেবল জানার জন্য জানা নয়, ভেতর থেকে অনুভব করার বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষ অসউইৎজ ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন- আজ ক্যাম্পের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে সাম্প্রদায়িকতা কত ভয়ংকর, কত বিষাক্ত।
অতীতের ভুল, গøানি বা বেদনা থেকে শিক্ষা নেবার জন্য তাই অবশ্যই উচিত এ সকল স্থানে যাওয়া, জানা। তবে এসব স্থানে যাওয়া বলতে কেবলমাত্র নিজের চেকলিস্টে টিক দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পর্যটকের সংবেদনশীলতাটাও জরুরি। ডার্ক ট্যুরিজমের স্পট অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটের চেয়ে আলাদা। এসব স্থান অতীতের বেদনাকে ধারণ করছে, তাই অবশ্যই পর্যটককে সেরকম মার্জিত আচরণ করতে হবে। যদি সারি সারি কবরের সামনে কেউ সেলফি স্টিক নিয়ে নিজের সবচেয়ে ভালো প্রোফাইল পিকচার তুলতে বসে- তাহলে তা অত্যন্ত অশোভন হবে। সে কারণে এসব জায়গায় ভ্রমণের সময় নিজের আচরণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, আপনার আচরণ যেন কোনোভাবে স্থানীয় মানুষ বা যাদের ইতিহাস তাদেরকে আঘাত না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ডার্ক ট্যুরিজম বা যেকোনো ধরনের ভ্রমণের সময় ভ্রমণের স্থান, সেখানকার মানুষ এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানার সাথে সাথে পর্যটকের সাথে সেই স্থানের জনপদের মধ্যে একধরনের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
পর্যটক সেই জনপদের স্থানে নিজেকে রেখে চিন্তা করার সুযোগ পায়, এভাবে অপরকে বোঝার মানসিকতা থেকে মানুষ বিদ্বেষমূলক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসে। মানুষ উদার হয়, সহমর্মী হয়। দিনশেষে এসব স্থানে ভ্রমণের পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কী সেটাই মুখ্য বিষয়। সেটা কি মৃত্যু ও বিষাদের প্রতি কৌতূহল? ইতিহাস জানার আগ্রহ? নাকি বন্ধুবান্ধবের মাঝে ব্যতিক্রম হবার ইচ্ছা?