জ্বালানি খাতে ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা
শাহীন চৌধুরী : দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানি শুরু করেছে সরকার। একই সাথে এই খাতে ঘাটতির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা না হলে এক পর্যায়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ফলে এই মুহূর্তে হ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া আর কোন বিকল্পের কথা ভাবছে না পেট্রোবাংলা। .
দেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে এলএনজি অনেকাংশ পূরণ করতে পারবে বলে আশাবাদ থাকলেও প্রশ্ন উঠেছে এলএনজি’র আমদানি ও সরবরাহ ব্যয় নিয়ে। বর্তমানে দেশে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হচ্ছে। এ বছরই আমদানিতে যুক্ত হবে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিমাণ এলএনজি আমদানি ও সরবরাহ খরচ বাবদ সরকারের ঘাটতি হবে ২৪ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর থেকে এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতির কবলে পড়বে দেশের জ্বালানি খাত। এ অবস্থায় সরকারের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল নাগাদ পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হলে ঘাটতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে এলএনজি আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট করা হবে। দুটি ভাসমান টার্মিনালের সঙ্গে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির জন্য একটি স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথম ইউনিট চালু হবে ২০২৩ সালে। এরপর ২০৩০ সালে উৎপাদনে আসবে দ্বিতীয় ইউনিটটি। এর মাধ্যমে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ বাড়বে।
এছাড়া পটুয়াখালীর পায়রাবন্দর এলাকায় দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও একটি স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হবে। আশা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ টার্মিনালটি উৎপাদন শুরু করবে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর করতে যদি বছরে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, তাহলে দৈনিক পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহে এই ব্যয় বাড়বে পাঁচ গুণ। যার পুরোটাই ঘাটতি হতে পারে বলে আশঙ্কা পেট্রোবাংলার। টাকার অংকে এর পরিমাণ হতে পারে ১ লাখ ২২ হাজার ৫০০ কোটি।
এখন দেশের জাতীয় বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ২৪ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আনা হলে বছরে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি সৃষ্টি হবে বলে দাবি পেট্রোবাংলার। এই হিসাবে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী, যখন পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হবে তখন জ্বালানি খাতে বছরে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে এর পাঁচ গুণ, টাকার হিসাবে আকার হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।
আর এই ব্যয় কীভাবে মেটানো হবে, তার কোনও পরিকল্পনা এ মুহূর্তে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বা পেট্রোবাংলার কাছে নেই। এই বিষয়টিকে সামনে এনে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে বাজেটের আকার বাড়লেও এর বড় একটি অংশই জ্বালানির ঘাটতি মেটাতে ব্যয় হবে। তারা বলছেন, এই চাপ সামাল দিতে এখনই ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে হবে সরকারকে। এখনই এই খাতের জন্য সরকারকে অর্থনৈতিক সমন্বিত পরিকল্পনায় বসতে হবে।
জানা যায়, ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির চুক্তি হলেও সরবরাহকারীরা দেবে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট। চুক্তির অংশ হিসেবেই এটা ঘটে। তাই এখানেও ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। পেট্রোবাংলার দেয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গড়ে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহে ব্যয় প্রতি ঘনমিটারে ৭ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৯ টাকা। ২০১৯ সালেই আরও ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হলে প্রতি ঘনমিটারে দাম পড়বে ১১ দশমিক ৭৭ টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঘাটতি বাদে যদি ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রতি ঘনমিটারে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৪৩ টাকা। তবে এরপর এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে ব্যয় কী পরিমাণ হবে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া কঠিন বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রুহুল আমিন জানান, প্রতিদিন যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি হচ্ছে তার সঙ্গে দুই হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট দেশীয় গ্যাস সংমিশ্রণ করে এলএনজির দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। আমরা নতুন নতুন স্থানে কূপ খনন করছি। সেখানে গ্যাস পেলে দেশীয় গ্যাসের পরিমাণ বাড়বে। ফলে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
সূত্রমতে, দেশের পুরনো ক্ষেত্রের গ্যাসের পরিমাণ কমে আসছে। নতুন বড় কোনও ক্ষেত্র এখনও পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় আগামী বছরগুলোতে দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ার বদলে কমতে পারে, যা এলএনজি’র ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এই বিপুল ব্যয় বাড়ানোর আগে আমরা তা কতোটা বহনের উপযুক্ত সেটা চিন্তা করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান