বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পহেলা বৈশাখ
মনজু আরা বেগম
শেষ হতে যাচ্ছে ১৪২৪। শুরু হচ্ছে ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। আবহমান বাংলা এবং বাঙালির ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির জীবনে একটি বৈচিত্রময় আনন্দঘন উৎসবমুখর দিন। ষড়ঋতুর এ দেশে বৈশাখ আসে ঘুরে ঘুরে নুতন রুপে নতুন বেশে। বাংলার ঘরে ঘরে নিয়ে আসে আনন্দ উৎসব। বাঙালি জাতি এ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। জাতির চেতনা উন্মোচনের এটি একটি বিশেষ দিন। প্রতিটি জাতির রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য চিন্তা চেতনা এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। বৈশাখের প্রথম দিনটি তাই জাতির জীবনে বয়ে আনে উৎসবের বারতা। নববর্ষের সাথে এদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এক গভীর সম্পর্ক ছিল বহুকাল পূর্ব থেকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈশাখ নুতন নুতন মাত্রা যোগ করছ্।ে সরকার বাঙালির ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ পর্বের মত বৈশাখকে বাঙালির জাতীয় অনুষ্ঠান হিসেবে স্বৃীকৃতি দিয়ে সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উৎসব ভাতা প্রদান করছে যা জাতিকে তার সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে ধরে রাখতে উৎসাহ উদ্দীপনা প্রদান করছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎসব ও পালা পার্বণকে সামনে রেখে সারা বছরই বিভিন্ন ধরনের মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৪২৫ নুতন বছরকে স্বাগত জানাতে চৈত্র শেষ হতে না হতেই দেশজুড়েই পড়ে গেছে সাজ সাজ রব । হস্ত ও কারু শিল্পের দোকানগুলোতে পড়ে গেছে কেনাকাটার ধুম। বৈশাখকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট শিল্প মালিক থেকে শুরু করে হস্ত ও কারুশিল্পীরা অনেক আগে থেকেই তাদের ব্যবসাকে চাঙ্গা করার নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। ফুটপাথ থেকে শুরু করে অলিগলির দোকান পাঠ কিংবা বিলাসবহুল বিপনিবিতানে বৈশাখী পোষাক কেনাকাটার হিড়িক পড়ে। ফ্যাশন ডিজাইনাররা নুতন নুতন ডিজাইন দিয়ে শাড়ী, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জামা কাপড়, পাঞ্জাবী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পোষাক তৈরী করে যা তাদের ব্যবসায়ে এক নুতন মাত্রা যোগ করে। সুপার মার্কেটগুলোতে বিভিন্ন দোকানে দোকানে বৈশাখী সাজসজ্জার উপকরণে বিশেষ ছাড় দিয়ে ক্রেতাদেরকে উৎসাহিত করছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটেছে। এ উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয় অনলাইনে বৈশাখী পোষাকসহ বৈশাখী বিভিন্ন উপকরণ কেনাবেচার মধ্য দিয়ে। বড় বড় ব্রান্ড, করপোরেট ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে তাদের গ্রাহকদের বৈশাখী শুভেচ্ছা জানাচ্ছ্।ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও বৈশাখ বরনের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে যা বাঙালি জাতির জন্য একটি বিরাট বিনোদনের স্থান করে নিয়েছে। মৃৎশিল্পীরা তাদের তৈরী আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন শিল্প পণ্যে বৈশাখী কারুকাজে সমৃদ্ধ করে পসড়া সাজিয়ে বসেছ্ ে। শুধু তাই নয় মৃৎশিল্পীরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আকর্ষনীয় ডিজাইনে বিভিন্ন ধরনের মাটির গয়না বৈশাখী ডিজাইনে তৈরী করে চড়া দামে বিক্রয় করে। এসব আকর্ষনীয় ডিজাইনে তৈরী গয়না পোষাকের সাথে মিলিয়ে স্কুল কলেজের মেয়েরা নুতন উদ্যমে কেনা কাটা করছে। মাটির বাসনে পান্তাভাত, হরেক পদের ভর্তা, ইলিশ ভাজি, পাটশাক, শুটকি ভর্তা নিয়ে ছোট ছোট দোকানিরা দোকান সাজিয়ে তাদের ব্যবসাকে চাঙ্গা করতেই ব্যতিব্যস্ত থাকে। বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী গানের আসর বসে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। পালাগান জারি গান, পুতুল নাচ দেখার জন্য সবার মধ্যে একটা মানসিক প্রস্তুতি চলতে থাকে। ছোট ছেলেমেয়েরা মেলা থেকে বাঁশের বাঁশি,তালপাতার বাঁশি, মাটির তৈজসপত্র ক্রয় করার ধুম পড়ে যায়। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে দেখা যায় বৈশাখ উপলক্ষে দেশজুড়ে ২৪৫ থেকে ২৭০ টি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এসব মেলায় প্রচুর কেনা বেচা হয়। যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বাংলা নববর্ষ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়ে এটি আজ বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিনত হয়েছে। বৈশাখী মেলা প্রাচীন কাল থেকে গ্রামাঞ্চলে অনুষ্ঠিত হত। কিন্ত কালের বিবর্তনে এটি আজ আর গ্রামাঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই। বিসিক বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে পহেলা বৈশাখ হতে ১০ দিন ব্যাপি বাংলা একাডেমীর সাথে যৌথ উদ্যোগে মেলা করছে। শুধু রাজধানীতেই নয় সারা দেশব্যাপি বিসিক এ বৈশাখী মেলার আয়োজন করে থাকে। এ মেলার মাধ্যমে ছোট ছোট উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করার সুযোগ পায়।্ শুধু তাই নয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্য বিসিক শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী নির্বাচন করে পুরস্কারের ব্যবস্থা করছে। বৈশাখের প্রথম দিনটিতে গ্রাম বাংলার কৃষকেরা ভোরবেলা পিয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে পেটপুরে পান্তাভাত খেয়ে লাঙ্গল নিয়ে মাঠে যায় সবুজ ক্ষেতের বুকে সোনালী ফসল ফলাতে। লাঙ্গলের ফলা দিয়ে জমি চাষ করতে করতে সুরেলা কন্ঠে গায় ভাটিয়ালি গান। দোকানীরা হালখাতার আয়োজন করে। এ দেশে আবহমানকাল থেকে পুন্যাহ,হালখাতা ও বৈশাখী মেলা আয়োজন করে এলেও জমিদার জোতদার শ্রেনী বিলুপ্ত হওয়ায় পূণ্যাহ প্রথাও বিলুপ্ত হয়েছে। পূণ্যাহ হচ্ছে জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানের দিন। এ অনুষ্ঠানটি ছিল জমিদার,বড় বড় জোতদার ও সর্বস্তরের প্রজাদের একটি সার্বজনিন উৎসব। এই দিনটিতে খাজনা আদায়ের নতুন খাতা খোলা হত। এই দিনে প্রজারা নতুন কাপড়চোপড় পরে জমিদার,জোতদারদের তালুক বাড়িতে খাজনা দিতে আসতো। জমিদাররা কেউ প্রজাদের পানসুপারি খাওয়াতো কেউবা মিষ্টিমুখ করাতো। জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান তা এই একটি দিনে এই ব্যবধান কিছুটা হলেও কমে আসতো। গ্রামবাংলার ভাটিয়ালী লোকগীতিকে অমর করে রাখতে রাজধানীতে রমনার বটমূলে কাকডাকা ভোর থেকে শুরু হয় বৈশাখী অনুষ্ঠান। বৈশাখ এখন শুধু সারা দেশজুড়েই ছড়িয়ে পড়েনি। এটি দেশের গন্ডি পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক পর্যায়েও স্থান পেয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তে বাঙালিরা বসবাস করে সেখানেই বৈশাখী উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিস্তৃত হচ্ছে। এটি এখন শুধু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেই সীমাবদ্ধ নেই। এ অনুষ্ঠানগুলোর সাথে জড়িয়ে গেছে এক বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। যুগের চাহিদা এবং রুচির পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে যাচ্ছে ধ্যান ধারনা ও রুচিবোধ। তাই নববর্ষ প্রতিবছরই আসে নতুনবেশে নতুন রুপে। নববর্ষের প্রভাব আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপক। বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের তাঁত শিল্প,জামদানী শিল্প উজ্জীবিত হয়। তাঁতীরা বহু আগে থেকে নিত্য নতুন ডিজাইনের কাপড় তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বুটিকস ও ফ্যাশন হাউসগুলো এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভ’মিকা রাখছে। এ ভাবেই পহেলা বৈশাখ আমাদের অর্থনীতিকে সচল করার সাথে সাথে অর্থনীতির প্রাণসঞ্চার করছ্ ে।
লেখক, গবেষক ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
সড়হলঁধৎধ২০০৬@ুধযড়ড়.পড়স