স্থানীয় প্রশাসন ও মাদরাসার গভর্নিং বডি যথাসময়েপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে নুসরাত হত্যা এড়ানো যেতো
ইসমাঈল ইমু : জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কমিশনের পরিচালক আল মাহমুদ ফয়জুল কবিরকে আহŸায়ক এবং উপপরিচালক এম রবিউল ইসলামকে সদস্য সচিব করে গত ১১ এপ্রিল দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও উপস্থিত ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা গত ২৭ মার্চ নিজ অফিস কক্ষে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন এবং তার নির্দেশে তার ঘনিষ্ঠ সহচররা ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে ১০ এপ্রিল নুসরাত মারা যান।
এতে বলা হয়েছে, যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর পুলিশ নুসরাতকে বিভিন্ন অশ্লীল প্রশ্ন করেছে এবং বিষয়টিকে হালকা ঘটনা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সোনাগাজী থানার অফিসার ইনচার্জ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
সিরাজ উদ দৌলার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯৫ সালে দৌলতপুর ছালামতিয়া মাদরাসার সুপার ছিলেন তিনি। তখন ওই মাদরাসার ছাত্রদের সঙ্গে তার সমকামিতার অভিযোগ ছিলো। তার বিরুদ্ধে আদালতে একাধিক প্রতারণার মামলা চলমান। প্রতারণার মামলায় ইতিপূর্বে জেলও খেটেছেন তিনি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সিরাজ উদ দৌলা ২০০১ সাল থেকে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি নিয়মিত ছাত্রীদের তার অফিস কক্ষে ডাকতেন। অফিস কক্ষে একই সময়ে একজন ছাত্রীর বেশি প্রবেশ নিষেধ ছিলো। তার যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রী ও অভিভাবকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মাদরাসার গভর্নিং বডি ও থানায় অভিযোগ করেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সিরাজ উদ দৌলার এক সময়ের ছাত্র নুরুদ্দিন তার সব অপকর্মের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলো এবং গভর্নিং বডির সদস্য মুকছুদ ও কেরানি সিরাজ তার একান্ত সহচর ছিলো বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম বর্ষ থেকেই নুসরাতের ওপর দৃষ্টি পড়ে সিরাজ উদ দৌলার। সিরাজ উদ দৌলা তাকে বিভিন্ন সময় কুপ্রস্তাব দিতেন এবং সুযোগ পেলেই গায়ে হাত দিতেন। ২৭ মার্চ বেলা ১১টার দিকে সিরাজ উদ দৌলা তার পিয়ন নুরুল আমিনকে নুসরাত জাহান রাফির ক্লাসে পাঠায় তাকে নিজ অফিস কক্ষে নিয়ে আসার জন্য। নুসরাত ভীত হয়ে তার দুই বান্ধবী নিশাত ও ফুর্তিকে নিয়ে অফিস কক্ষের দিকে যায়। নিশাত ও ফুর্তি অফিস কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এবং নুসরাত অফিস কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে।
সিরাজ উদ দৌলা তার সিট থেকে উঠে এসে নুসরাতের পাশে দাঁড়ায় এবং পরীক্ষার প্রশ্ন অগ্রিম দিয়ে দেয়া ও পরীক্ষার আধঘণ্টা আগে তার কক্ষে আসার প্রস্তাব দেয়। নুসরাত রাজি না হওয়ায় টান দিয়ে তার মুখের স্কার্প খুলে ফেলে এবং পিছন থেকে জাপটে ধরে বুকের স্পর্শকাতর অংশে হাত দেয়। একপর্যায়ে নুসরাত হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। সিরাজ উদ দৌলা কলিংবেল টিপে পিয়ন নুরুল আমিনকে ডাকেন এবং বলেন নুসরাত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নুরুল আমিন নুসরাতকে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু অবস্থায় বসে থাকতে দেখে। নুসরাত তখন দৌড়ে অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেÑবলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, সিরাজ উদ দৌলা কক্ষ থেকে বের হয়ে নুসরার তার বান্ধবী নিশাত ও ফুর্তিকে সব ঘটনা বলে এবং বাড়ি চলে যায়। নুসরাতের মা তখন ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়েছিলেন। তিনি মোবাইলে তার ছেলের কাছ থেকে জানতে পারেন নুসরাতকে সিরাজ উদ দৌলা তার কক্ষে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যেহেতু আগে থেকে অনেক কিছু জানতেন তাই বাড়ি না এসে লোকজন নিয়ে সরাসরি সিরাজ উদ দৌলা অফিস কক্ষে যান এবং সেখানে থাকা বেতের লাঠি দিয়ে সিরাজ উদ দৌলাকে কয়েকটি বাড়ি মারেন। সন্ধ্যায় তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় থানায় মামলা করেন। সিরাজ উদ দৌলা গ্রেপ্তার হন এবং নুসরাত ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয়।
পরীক্ষার হলে নুসরাতের সামনের সিটে বসা ছাত্রী নুসরাতকে বলে কে বা কারা তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নিশাতকে ছাদে মারধর করছে। নুসরাত ছাদে ছুটে যায় এবং সেখানে সিরাজ উদ দৌলার ঘনিষ্ঠ সহচরদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তারা নুসরাতের হাত বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনে নুসরাতের হাতের বাঁধন খুলে গেলে সে গায়ে আগুন নিয়ে চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। উপস্থিত কর্মচারী ও পুলিশ সদস্য রাসেল তার গায়ের আগুন নিভিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের ভর্তি করা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে নুসরাত জাহান রাফি ১০ এপ্রিল রাত ৯টায় মারা যায়। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান