পুলিশের গাফিলতির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্তটিম ফেনীতে
শাহজালাল ভূঁঞা: ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও গাফিলতির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (মিডিয়া) রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের তদন্তটিম বুধবার ফেনীর সোনাগাজীতে যান। তদন্তদলের সদস্যরা নুসরাত জাহান রাফির পরিবারের সদস্য, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলেন। এছাড়াও নুসরাত জাহান রাফির কবর জেয়ারত করেন এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন।
পরে পুলিশ তদন্তদলের সদস্যরা সাংবাদিকদের জানান,ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের কোনো অবহেলা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত কমিটি সরেজমিনে এসেছেন। তদন্তে পুলিশের কোনো দুর্বলতা প্রমাণ পেলে কেউ রেহাই পাবে না। তদন্তে এ হত্যাকান্ডোর সাথে পুলিশ প্রশাসনের কেউ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জড়িত থাকলে তাকে ছাড় দেয়া হবে না।
গতকাল সকালে ঢাকার কামরাঙ্গীর চর থেকে হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মুহাম্মদ শরীফকে আটক করেছে বলে জানান পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পরিদর্শক মো. শাহ আলম। এজহারভুক্ত আসামী নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিতে এ শরীফের নাম উল্লেখ করেন। শরীফ ঘটনার দিন মাদ্রাসার গেট পাহারায় ছিলেন।
হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে আটক নুসরাতের সহপাঠী কামরুন নাহার মনিকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সরাফ উদ্দিন আহম্মেদ এর আদালত ৫ দিনের রিমান্ড দিয়েছে। ফেনীর কোর্ট পরিদর্শক গোলাম জিলানী জানান, সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়েরে করা সন্দেহভাজন এ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে হাজির করে আদালতের কাছে ১০ দিনের রিমান্ডে আবেদন করলে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
নুসরাতের আইনজিবী অ্যড. শাহজাহান কবির সাজু বলেন, আসামী নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীমের স্বীকারোক্তিমূরলক জবানবন্ধীতে নুর নাহার মনির কথা উঠে আসে। সে এ ঘটনায় বোরখা ক্রয় করে সরবরাহ করেছিলো। ১৫ এপ্রিল সোমবার দিনগত রাতে কামরুন নাহার মনি আটক করা হয় বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। জানা যায়, আটককৃত মনি সোনাগাজী বাসস্ট্যান্ডের ঈমান আলী হাজী বাড়ির মরহুম বিডিআর আজিজুল হকের পালিত মেয়ে।
এদিকে, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. রেজাউল হক পিপিএম গত ১৩ এপ্রিল স্বাক্ষরিত এক স্মারকে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (মিডিয়া এন্ড প্ল্যানিং) রুহুল আমিনকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির অন্যান্যরা হলেন- অ্যাডিশনাল আইজি (সিআইডি এর প্রতিনিধি), ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জের প্রতিনিধি, অ্যাডিশনাল এসপি (পুলিশ হেডকোয়ার্টার) সম্রাট মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান ও পুলিশ পরিদর্শক (পুলিশ হেডকোয়ার্টার) মো. সালাউদ্দিন আরশেদ।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) অভিযোগ করেন নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মামলা করতে পরিবার ‘কালক্ষেপণ’ করেছে। ঘটনার পর পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো চিঠিতে তিনি এই অভিযোগ করেন। এদিকে নুসরাতের পরিবার বলছে, সোনাগাজী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) রক্ষায় এমন চিঠি দেওয়া হয়েছে। পুড়িয়ে মারার ঘটনাকে প্রথম থেকেই পুলিশ ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি মামলার এজাহার নিয়েও পুলিশ কূটচাল চেলেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা নিয়ে ফেনীর এসপি জাহাঙ্গীর আলম ১১ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দপ্তর, বিশেষ শাখা ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির দপ্তরে পাঠানো হয়।
পুলিশ সুপারের চিঠিতে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন নুসরাত মাদ্রাসায় যান। এরপর তার বসার স্থানে ফাইলপত্র রেখে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদের ওপরে বাথরুমের কাছে যান। কিছুক্ষণ পর গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে আসেন। তখন কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ও মাদরাসার কর্মচারীরা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তারা মামলা করতে কালক্ষেপণ করে। পুলিশ নুসরাতের চাচাকে বাদী করে মামলা করতে গেলে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান আপত্তি জানান। তিনি দুবার এজাহার বদল করেন।
নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা জানান, ঘটনাটি এমনভাবে বলা হয়েছে যাতে মনে হচ্ছে, নুসরাত নিজের ইচ্ছাতেই ভবনের ওপরে যান। অথচ তাকে পরিকল্পনা করে ডেকে নেওয়া হয়। এরপর হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কোনো কথাই উল্লেখ করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, সোনাগাজীর ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাতকে ৬ এপ্রিল হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। চার দিন জীবনের সঙ্গে লড়ে ১০ এপ্রিল রাতে তিনি ঢাকা মেডিকেলে মারা যান। এ ঘটনায় করা মামলায় ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি আছেন সাতজন। এজাহারভুক্ত এক আসামি এখনো পলাতক। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলাটি তদন্ত করছে।