১৫ দিনে ৩৯ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নির্যাতনের শিকার ৮ জন
ফাতেমা আহমেদ : যৌন হয়রানি থেকে বাঁচতে শিশুদের সচেতন করতে হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে শিশুদের সাথে কথা বলা কঠিন। দেশে গত ১৫ দিনে ৪৭টি শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি ধর্ষণের ঘটনা। উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এই তথ্য দিচ্ছে। শিশুদের প্রতি এমন নির্যাতনের সংখ্যা হঠাৎ বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। বিবিসি বাংলা
যারা এসব ঘটনার শিকার, সে শিশুদের যৌন নির্যাতন কাকে বলে, তাদের নিজের সাথে তা ঘটছে কিনা, সেটি শিশুরা কীভাবে চিহ্নিত করবে? এমন স্পর্শকাতর বিষয় অভিভাবকেরা ছোট শিশুদের কীভাবে শেখাতে পারেন? বিষয়টা জানানো দরকার। কিন্তু তা কতোটা মুশকিল?
একজন কর্মজীবী মা উদ্বেগের কারণ ব্যাখ্যা করে বলছিলেন, ‘চারপাশে আজকাল যা ঘটে তা খুবই ভীতিকর। যেমন কিছুদিন আগে ডেমরায় দুটো বাচ্চা খেলা করছিলো। ওদের লিপস্টিক কিনে দেবার কথা বলে নিয়ে গিয়ে রেপ করে মেরে ফেলেছে। এই খবরটা যখন দেখলাম তখন সাথে সাথেই আমার নিজের বাচ্চা দুটোর চেহারা ভেসে উঠলো। এইগুলোর কারণেই আমি সবসময় একটা টেনশনে থাকি।’
এই মা বলছেন সন্তানকে তিনি সেভাবেই প্রস্তুত করছেন। তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন।
তিনি বলছেন, ‘আমি ওদের শিখিয়েছি কোন স্পর্শটা ভালো আর কোনটা খারাপ। আমি আমার বাচ্চাদের সাথে একটা ওপেন রিলেশনশিপ তৈরির চেষ্টা করেছি। ওরা যেনো আমাকে সব কিছু বলতে পারে। তারা নিজেরাই নিচে খেলতে যায়। তাদের শিখিয়েছি কেউ যদি তোমাকে বলে আমার সাথে আসো, তোমাকে খেতে দেবো, তোমার মা বলেছে, তুমি কখনোই যাবে না।’
ছেলে শিশুদের কথা ভাবেন না অনেকেই। এদের নিয়েও ভাবা দরকার। নানা উদ্বেগের কারণে সাত বছর বয়সী ছেলের দেখভালের জন্য মাহিন চৌধুরী চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছেন। ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেন না প্রায় কখনোই। কিন্তু ছেলে সন্তান বলে তার প্রতি যৌন নির্যাতনের কোন ঘটনা ঘটতে পারে, তিনি সেটা ভাবেন না। তিনি বলছেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমার যদি মেয়ে বাচ্চা হতো তাহলে এ ব্যাপারে অনেক বেশি চিন্তিত হতাম। এখন তুলনামূলকভাবে চিন্তাটা কমই আসে। তারপরও বাচ্চার কথা চিন্তা করেই আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।’
মাহিন চৌধুরী বলছেন, ‘একটি ছোট বাচ্চাকে বিষয়টি বোঝানো খুব কঠিন। কিন্তু তিনি যৌন নির্যাতনের বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। একটি শিশুর মাথায়, যৌন নির্যাতনের ধারণাটা অনুপস্থিত। আপত্তিকর বিষয়টিও সে বোঝে না। তাই তার কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই। দেশের বাইরে অভিভাবকদের ট্রেইন করা হয়। সচেতনতামূলক অনেক বার্তা থাকে। আমি ছেলেকে ভালো আদর, খারাপ আদর বিষয়টির পার্থক্যটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি।’
তামিম হাসানের স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন দুই বছর আগে। তিনি ‘সিঙ্গেল প্যারেন্ট’। সাড়ে তিন বছরের সন্তানকে বড় করতে তিনি তার পরিবারের সহায়তা পাচ্ছেন। মায়ের উপরে তিনি অনেকটাই নির্ভরশীল। শিশুটির মা না থাকায় তিনি বাড়তি মনোযোগ দেন। তাই ছেলের ব্যাপারে তার উদ্বেগ আরও বেশি। তবে তার মতে বাবাদের জন্য শিশুদের এই বিষয়ে শেখানো বেশ কঠিন, কারণ বাংলাদেশের সমাজে বাবাদের সেভাবে তৈরি করা হয় না। সন্তানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার ধরন ভিন্ন।
শিশুরা এমন প্রসঙ্গ বোঝার ক্ষমতা রাখে না। তবু তাকে জানাতে হবে। তিনি বলছেন, ‘মা যেভাবে বাচ্চাদের সাথে মিশতে পারে, বাবা সেভাবে পারেন না। বাবাদের সাথে ছেলেমেয়েদের দূরত্ব থাকে। বাবারা কাজের জন্য বাইরে থাকেন বেশি। তাই সময় দিতে পারেন কম। আর সিঙ্গল মায়ের থেকে সিঙ্গল বাবাদের জন্য বিষয়টা আরও কঠিন।’
শিশুদের এরকম একটি বিষয়ে কীভাবে জানানো যায় সে প্রসঙ্গে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ডা. ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, শিশুকে তার শরীরের তিনটি জায়গা সম্পর্কে জানাতে হবে। জানাতে হবে তার ঠোঁট, গোপনাঙ্গ ও পায়ুপথ তার বিশেষ জায়গা। এখানে বাবা মা গোসল করানো বা পরিষ্কার করার সময় ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ সেটি করলে সে কি করবে তাও তাকে জানানো। বাবা মাকে যে জানাবে সেটিও শেখাতে হবে। এতে বাচ্চারা সচেতন থাকবে।
ডা. ইশরাত বলছেন, ‘বিষয়টি জানানোর কাজ সঠিকভাবে করার জন্য আগে অভিভাবকদের নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। জিনিসটা করতে হবে একটু খেলার ছলে, ছবি এঁকে অথবা গল্প করে ধীরে ধীরে ধারণাটা তার মাথায় দিয়ে দিতে হবে। বড় বাচ্চাদের মুখে বলা যেতে পারে। কিন্তু শিশুরা সবকিছু ভুলে যায়। তাদের মধ্যে সন্দেহ কম, তাই বিষয়টি তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে।
তিনি বলছেন, ‘শিশুর আচরণের পরিবর্তন খেয়াল করতে হবে। আচরণ থেকেও অনেক সময় অনেক কিছু বোঝা যায়। সে যদি কাউকে দেখে ভয় পায়, কারো কোলে যেতে না চায়, তাকে জোর করা উচিৎ নয়। যে বাচ্চা বিছানা ভেজানো বন্ধ করে দিয়েছে, সে যদি হঠাৎ আবার তা করে, সে যদি ভয় পেয়ে চমকে ওঠে বা রাতে দুঃস্বপ্ন দেখছে, এমন পরিবর্তন খেয়াল করতে হবে।’
বাংলাদেশে শিশুদের কথা না শোনার একটি প্রবণতা রয়েছে অভিভাবকদের। শিশুর কথা শুনতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে। ডা. ইশরাত শারমিন বলছেন, ‘বাচ্চারা যদি কখনো এই বিষয়ে কিছু বলে তবে তা সিরিয়াসলি নিতে হবে, বাবা মাকে বিশ্বাস করতে হবে। কারণ বাচ্চারা যতরকম গল্প বানিয়ে বলুক না কেনো এই বিষয়ে বানিয়ে কথা বলার ক্ষমতা তার থাকার কথা নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলছেন, ‘সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করার ভয়ে অনেক সময় এগুলো নিয়ে সবাই চুপ থাকে। কিন্তু পরিবারের সবাইকে একসাথে বসে এগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে যে, আমাদের শিশুরা কারো কাছে নিরাপদ নয়।’
তিনি বলছেন, ‘আপনি কেনো ভাবতে যাবেন আপনার ভাইকে বা বাবাকেও আপনার সন্দেহ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই আলোচনাটা যদি পরিবারে খাবার টেবিলে হয়ে যায়, তাহলে সকলেই বিষয়টা সম্পর্কে সচেতন থাকে।’ সম্পাদনা : রেজাউল আহসান