আমাদের বিশ্ব • আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ১
২৫ কোটি টাকার অধিক খেলাপিঋণের মামলা ‘ফাস্ট ট্র্যাক’-এর আওতায় আসছে
সোহেল রহমান : খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে ২৫ কোটি টাকার অধিক মূল্যমানের মামলা ‘ফাস্ট ট্র্যাক’-এর আওতায় আনা ও মামলা নিষ্পত্তিতে যৌক্তিক সময় নির্ধারণসহ বিদ্যমান ‘অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩’-এর আমূল সংস্কার হচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছেÑবড় অংকের ঋণ গ্রহীতা অর্থাৎ ৫ কোটি টাকার বেশি স্থিতিসম্পন্ন ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগে নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে পেশাদার মেডিয়েটরদের নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে মেডিয়েশনের প্রচেষ্টা এবং তৎপরতা চালানো বাধ্যতামূলক করা; অর্থঋণ আদালতে মামলার অবস্থা যা-ই হোক না কেন প্রয়োজনে বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করা; ঋণ খেলাপি কর্তৃক রিট মামলার ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ব্যাংকে জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ ও এক মামলায় একাধিক রিটের সুযোগ না রাখা, আদালত কর্তৃক সুদ মওকুফের কোনো বিধান না রাখা ইত্যাদি। এছাড়া কোনো ঋণ খেলাপির মৃত্যু হলে ঋণের দায় উত্তরাধিকারীদের বহন করতে হবে এবং এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের কারণ অনুসন্ধান এবং খেলাপি ঋণ আদায় জোরদার করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটির বিষয়ে মতামতের জন্য ইতিমধ্যেই এটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামত পাওয়ার পর এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে পাঠানো হবে।
প্রতিবেদনে বিতরণকৃত ঋণ খেলাপি হওয়ার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুর্বলতাকে দায়ী করে বলা হয়েছে, ঋণ পুনঃতফসিলকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহারের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অন্যদিকে আইনগত দুর্বলতার কারণে খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ আছে, অর্থঋণ আদালতে মামলায় আটকে আছে এর চেয়েও বেশি পরিমাণ অর্থ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের হিসাব মতে, বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলায় অর্থঋণ আদালতে ৫৭ হাজার ৪১৬টি মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। এসব মামলার মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রিট মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৩৭৬টি। এর বিপরীতে দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ৫২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা।
বিতরণকৃত ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ গ্রহীতা নির্বাচনে দুর্বলতা, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের অপর্যাপ্ততা, অতি মূল্যায়ন ও ঝুঁকি বিশ্লেষণে দুর্বলতা, এক ব্যাংক কর্তৃক অন্য ব্যাংকের খারাপ ঋণ অধিগ্রহণ, চলতি মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ না করা, একাধিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধণ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান, শাখা পর্যায়ে ঋণ প্রদানের ক্ষমতা সীমিতকরণ ও ঋণ পুনঃতফসিলকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহার খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ।
এসব সমস্যা সমাধানে মনিটরিং বাড়ানো, পর্যবেক্ষক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি, ভালো ঋণগ্রহীতাদের প্রণোদনা প্রদান, ভালো ব্যাংককে পুরস্কৃত করা, খারাপ ব্যাংকের পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, পারফরমেন্স মূল্যায়ন, ঋণ প্রদানে ঝুঁকি না নেয়া, এনওয়াইসি (নো ইউর কাস্টমার) ভালোভাবে যাচাই করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়েরের পর সে আইনের অধীনে মেডিয়েশনের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা প্রায় ক্ষেত্রেই অসফল থেকে যাচ্ছে। কারণ, মামলা দায়েরের আগেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি অধিকতর কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেসব দেওয়ানী মামলা (যার মূল্য ২৫ কোটি টাকার কম) পূর্ববর্তী মেডিয়েশনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়নি, সেগুলো নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানের তদারকির মাধ্যমে পেশাদার আরবিট্রেটর নিয়োগ করে নিষ্পত্তির জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পাঠানো যেতে পারে। এসব আরবিট্রেশন প্রক্রিয়া ‘ফার্স্ট ট্র্যাক’ সোল আরবিট্রেটরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। আর নিষ্পত্তির জন্য একটা যৌক্তিক সময়সীমা বেঁধে দেয়া যেতে পারে। একইভাবে ২৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের মামলা ‘ফার্স্ট ট্র্যাক’-এর আওতায় আদালতের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান করা যেতে পারে।
ঋণ খেলাপির ঋণের দায় উত্তরাধিকারীদের বহন করার বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যেহেতু উত্তরাধিকারীরা ঋণ খেলাপির সম্পদ ভোগ করবে, তাই এর দায়ও তাদের নিতে হবে। প্রসঙ্গত ‘অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩’-এর ৩৪(২) ধারা মতে, ঋণগ্রহীতার মৃত্যু হলে পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী স্থলাভিষিক্ত দায় ওয়ারিশদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে নাÑ বলে উল্লেখ রয়েছে। এজন্য এটি সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান