৫০ বিঘা জমি চাষাবাদ করেও আর্থিক আবেদন জানাচ্ছি, মানবিক আবেদন নয়
মো. নজরুল ইসলাম
মাসের মেস ভাড়া, খাবার খরচ যাতায়াতসহ আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়, যার পুরোটা পরিবারকেই বহন করতে হয়।
দুপুরে টাকা চাওয়ার জন্য বাড়িতে ফোন দিলে আমার আর আব্বার কথোপকথনটা অনেকটা এ রকম ছিলো…
আমি : আসসালামু আলাইকুম আব্বা, ভালো আছেন? আব্বা : হ বাবা ভালাই আছি, তোমার পরীক্ষা কবে শেষ হবো? আমি : সামনের বৃহস্পতিবার শেষ হবে আব্বা। আব্বা: শেষ হইলে তাড়াতাড়ি বাড়িত আইসা পরিস। ধান কাটা শুরু হইছে, কামলার দাম ৮০০ টাকা, আর ধান বেচবারও পাইতাছি না। আমি : আচ্ছা, আব্বা চলে আসবো বলেই-ফোনটা রেখে দিলাম। আমি আর বেশি কিছু বলতে পারলাম না, এ মাসের খাবার খরচ, বুয়ার বেতন কিছুই দেয়া হয়নি এখনো। টাকা চাওয়ার মতো কোনো সুযোগ পেলাম না, আর সাহসও দেখালাম না। ফোনটা রেখে দশ মিনিট চুপ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম!
অনেকে হয়তো বলবেন, এতো জমিজমা, তোমার বাপে তো মিয়া জমিদার! এতোই যখন অভাব কিছু জমি বিক্রি করলেই তো হয়। অভাবের কথা বলতে গিয়ে অনেক সরকারি চাকরিজীবী মা-বাবার সন্তান যারা আমার বন্ধু তাদের কাছে এমন কটু কথাও শুনতে হয়েছে যে, এতো জমাজমি দিয়ে তর বাপে করবেটা কি? বিক্রি করে টাকা দিতে বল।
হ্যাঁ, তাদেরই বলছি। কেন বলছি জানেন?
আমার মতো কৃষকের ছেলেদের মনে চাপা ক্ষোপ সৃষ্টি হয়েছে। যে দেশে ৭৫ শতাংশ লোক কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত, মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ কৃষিতে। আজকে সেই কৃষকরা পথে বসার মতো অবস্থা। আমাদের বাবারা না পারে কাউকে কিছু বলতে, না পারে অন্যের জমিতে কাজ করতে। কেননা আমাদের অনেক জমিজমা আছে, সমাজ আমাদের জমিদার উপাধি দিয়েছে। দিনের পর দিন কাঠপোড়া রোদে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমার বড় ভাই, বাবা কষ্ট করে তিলে তিলে সংসারটকে দাঁড় করিয়েছে। অতীতে অতোটা অভাবও ছিলো না। এই অভাবটা কেন সৃষ্টি হয়েছে জানেন?
প্রতি বিঘা জমি ধান কটতে খরচ হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। আরও তো অন্যান্য খরচ আছেই, সব মিলিয়ে প্রতি বিঘা জমিতে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ। একবার হিসাব করে দেখেন তো ৫০ বিঘা জমিতে মোট কতো খরচ হয়। আমিই হিসাবটা করে দিচ্ছি (৫০দ্ধ১৪০০০=৭০০০০০) ৭ লাখ টাকা।
আর আয় দেখবেন?
ধান প্রতিমণ বিক্রি হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। প্রতি বিঘায় ২০/২২ মণ ধান হলে প্রতি বিঘায় ১০/১১ হাজার টাকা আসে, সর্বমোট ৫ লাখ টাকা। লোকসানটা আপনারাই হিসাব করে দেখেন। এর মধ্যে আমার খরচ, পরিবারের খরচসহ সব তো আছেই।
যেখানে আমাদের মন্ত্রী মহোদয় দাবি করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কানাডার সমান। আমার কথা হচ্ছে, এই আয়টা হচ্ছে কাদের? দেশটা কি শুধুই সেই ২৫ শতাংশ মানুষদের জন্য, নাকি ১০০ শতাংশ মানুষের?
এই প্রবৃদ্ধিতে তো ৭৫ শতাংশ মানুষ কোনো উপকৃত হচ্ছে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু আমাদের মতো পরিবারের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না কেন? স্বাধীনতার অর্ধশত বছর হতে যাচ্ছে, এখনও কৃষকের ভাগ্য বদলাচ্ছে না।
এমন অবস্থায় মনে হচ্ছে এবার নায়ক-নায়িকা ও শিল্পীদের মতো আমাদেরও সরকারের কাছে সাহায্যের হাত পাততে হবে। তবে কৃষকদের তো সরকার আবার কোনো সাহায্য দেয় না। ব্যাংক লোন নিতে গেলেও অনেক ঝামেলা, সময়মতো টাকা না দিতে পারলে কৃষকদের কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতেও নেয়া হয়। এক লাখ কোটি টাকার উপরে ঋণখেলাপিদের মাফ করা হয়, কৃষকের বেলায় উল্টো কেন?
ভাবছি ক্যাম্পাসে প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টে গিয়ে গিয়ে আর্থিক সাহায্য চাইবো। লোক লজ্জার ভয় আর কতোদিন!
লেখক : গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়