গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতেই দেশে ফিরে আসি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বললেন প্রধানমন্ত্রী
ফাতেমা আহমেদ : আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের জন্য কাজ করতে এবং গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। কেননা, গণতান্ত্রিক ধারা ছাড়া দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি সম্ভব নয়। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন, চ্যানেল আই অনলাইন, বাংলানিউজ
শুক্রবার তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে দলের নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশে যখন ফিরেছিলাম (১৯৮১ সালের ১৭ মে), সেদিন আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিলো। বিমানটি বাংলার মাটি ছুঁয়েছে, ট্রাকে করে আমাদের নিয়ে আসা হচ্ছে। ওই সময় ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ এসেছিলো। এয়ারপোর্ট থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত এত মানুষের ঢল যে এইটুকু পথ আসতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগে গিয়েছিলো।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সেই নির্মম ঘটনার স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘মাত্র ১৫ দিন আগে, জুলাই মাসের ৩০ তারিখে ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে আমি জার্মানিতে গিয়েছিলাম। রেহানা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কলেজে গেলাম। সবাইকে রেখে গিয়েছিলাম, কামাল, জামাল, রাসেল। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় শুনলাম, আমাদের কেউ নেই, আমরা নিঃস্ব। আমাদের দেশেও আসতে দেয়া হলো না। একপর্যায়ে চাচা এসে আমাদের নিয়ে যায়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে আসব। আমি জানি না কী করব, কোথায় থাকব, কই যাব। অনেক বাধা, অনেক বিপত্তি। তবু সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে আসতেই হবে।
বঙ্গবন্ধুই রাজনৈতিক আদর্শ ছিলেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাজনীতির কাজ করে যেতাম আব্বার আদর্শ নিয়ে। তিনি দেশের জন্য কাজ করেছেন। বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। আমরা কখনো টানা দুই বছরও আব্বাকে জেলের বাইরে পাইনি। এ নিয়ে আমাদের কোনো হা-হুতাশ ছিল না। আমার মা খুব চিন্তাশীল ছিলেন, তিনি বাসাও দেখতেন, বাইরেও দেখতেন। সাংসারিক কোনো ঝামেলা তিনি আব্বাকে দিতে চাইতেন না। আমাদের দাদা-দাদী, চাচারা পারস্পরিক সহযোগিতা করতেন। কাজেই এমন একটি পরিবেশ থেকে আমরা উঠে এসেছি, যে মাথাতেই ছিল দেশের জন্য কিছু একটা করে যেতে হবে।
দেশে ফেরার পরের প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তিনি বলেন, ‘দেশে ফেরার পর থেকেই পদে পদে বাধা। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, তারাই তখন ক্ষমতায়। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ১৯টি ক্যু হয়েছিলো। এক সামরিক শাসকের মৃত্যুর পর আরেক সামরিক শাসক আসলো। আমরা আওয়ামী লীগ কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য একটার পর একটা সংগ্রাম করেই গেছি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, গণতান্ত্রিক ধারা আর ব্যবস্থা ছাড়া দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব না।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময় ছাড়াও ২০০১ সালের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তা সত্ত্বেও দলকে টিকিয়ে রাখতে যারা অবদান রেখেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ঠিক যেভাবে গড়ে উঠেছিল, ঠিক সেভাবেই আজ বাংলাদেশের এক নম্বর পলিটিক্যাল পার্টি। আজ বাংলাদেশ সারাবিশ্বে সম্মানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ বলে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। আমি জানি না, যখনই একটা কাজ সফলভাবে করি, তখন শুধু আমার এটাই মনে হয় নিশ্চয় আমার আব্বা-আম্মা বেহেশত থেকে দেখছেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা বারবার চেয়েছে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে, তারা সফল হয়নি। আওয়ামী লীগ কিন্তু আওয়ামী লীগের মতোই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। আজকে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এক নম্বর রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় থেকে দেশের জন্য কাজ করে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ। এ কারণেই শুধু দেশে নয় গোটা উপমহাদেশে আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয় বরং একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদা ক্ষুণœ হোক, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হোক, গত ৩৮ বছরে এমন কোনও কাজ আমি বা আমার পরিবারের কোনও সদস্য কখনও করিনি। নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার জন্য কাজ করিনি, কাজ করেছি দেশের মানুষের জন্য। সব সময় চিন্তা করেছি মানুষকে কী দিতে পারলাম, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম। আমরা যতবার ক্ষমতায় এসেছি, মানুষের জন্য কাজ করেছি, তত মানুষের আস্থা- বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭৫-এর পড় এতো বড় দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে, এটা কখনও আমি ভাবিনি, চাইওনি, এটা চিন্তাও ছিলো না। কিন্তু নিতে হয়েছে। চরম প্রতিকূল পরিবেশের ভেতর দিয়ে দলকে সংগঠিত করতে হয়েছে।’ তবে টানা ৩৮ বছর দলের সভাপতি থাকা বোধহয় একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তখন উপস্থিত নেতাকর্মীরা সমস্বরে না বলে ওঠে। তারা শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনিই সঠিক নেতা, আপনার হাতেই দেশ ও দল নিরাপদ। আপনাকেই এ দায়িত্ব চালিয়ে যেতে হবে।’ জবাবে তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার মনে হয় আপনাদেরও সময় এসেছে, তাছাড়া বয়সও হয়েছে, এ বিষয়গুলো তো দেখতে হবে।’
প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হওয়ার পর কয়েক বছর বিদেশে অবস্থান করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দেশে ফিরে আসার আগে বিদেশে থাকা অবস্থায়ই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তিনি টানা ৩৮ বছর বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
অনুষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তারপর কলেজে ও ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রলীগেরই সদস্য ছিলাম। আর আওয়ামী লীগের (সদস্য) হলাম ৮১ সালে। আমার রাজনীতি ছাত্ররাজনীতি থেকেই শুরু। তবে কখনও কোনও বড় পোস্টে ছিলাম না, বড় পোস্ট চাইও নি কখনও। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। কখনও পদ নিয়ে চিন্তা করিনি, পদ আমরা চাইও নি। আমরা পদ সৃষ্টি করে সবাইকে পদে বসানোর এই দায়িত্বটাই পালন করতাম। প্রত্যেকটা কনফারেন্সে হাজির থাকতাম।’
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির শীর্ষনেতারা প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। ফুলেল শুভেচ্ছা জানান আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের শীর্ষনেতারাও।