ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশির মৃত্যু, ৩ পাচারকারী আটক
সুজন কৈরী : অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশী নিহতের ঘটনায় জড়িত চক্রের ৩ সদস্যকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করেছে র্যাব-১। তারা হলেন- শরিয়তপুরের মো. আক্কাস মাতুব্বর (৩৯), সিলেটের এনামুল হক তালুকদার (৪৬) ও বি-বাড়িয়ার মো. আব্দুর রাজ্জাক ভূইয়া (৩৪)। র্যাব বলছে, স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর নামে প্রতারণা করছে মানব পাচারকারী চক্রের কয়েকটি এজেন্সি। যাদের এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ঘুওে, উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে আট লাখ টাকায় ইউরোপে পাঠানোর নামে প্রতারণা করছে। ঘটনার তদন্তে নেমে ইউরোপে মানবপাচারের সঙ্গে অন্তত ১০-১৫টি চক্রের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে ৫-৬টি চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া বাংলাদেশিরা সেদিন নৌ-দুর্ঘটনায় পতিত হন। অবৈধভাবে পাঠানোকালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত র্যাবের ২০৯ অভিযানে ৬০৯জনকে আটক করা হয়েছে। ৭০৪ জন পুরুষ ও ১১০ জন নারীসহ মোট ৮১৪ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করেছে।
শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত আব্দুল্লাপুর, খিলক্ষেত ও বিমানবন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই তিনজনকে আটক করে। আটককৃতরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এমন অপরাধ করছে। এই সংঘবদ্ধ চক্রটি বিদেশী চক্র যোগসাজসে অবৈধভাবে ইউরোপে লোক পাঠিয়ে আসছে। এই সিন্ডিকেটটি ৩টি ধাপে কাজগুলো করত। সেগুলো হলো- বিদেশে গমনেচ্ছুক নির্বাচন, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাঠানো ও লিবিয়া থেকে ইউরোপ পাঠানো। তিনি জানান, ভুক্তভোগীদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। ইউরোপে পৌঁছে দিতে তারা ৭-৮ লাখ টাকা অর্থ নির্ধারণ করে, যার মধ্যে সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে এবং বাকি টাকা লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাত্রার আগে পরিশোধ করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এর মধ্যে অধিকাংশ টাকা পরিশোধ হয়ে যায়, যার ফলে ইচ্ছা থাকলেও আর ফেরত আসতে পারেন না ভুক্তভোগীরা।
মুফতি মাহমুদ খান জানান, চক্রটি লিবিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি রুট ব্যবহার করে থাকে। রুটগুলো তারা সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী মাঝে মধ্যে পরিবর্তন অথবা নতুন রুট নির্ধারণ করে। সম্প্রতি লিবিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে তারা ৩টি রুট ব্যবহার করছে। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ থেকে ইস্তাম্বুল (তুরস্ক) থেকে লিবিয়া, বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে শ্রীলংকা (৪-৫দিন অবস্থান) থেকে ইস্তা¤ু^ল (ট্রানজিট) থেকে ত্রিপলী (লিবিয়া) যাওয়া এবং বাংলাদেশ থেকে দুবাই (৭-৮ দিন অবস্থান) থেকে আম্মান (জর্ডান) (ট্রানজিট) থেকে বেনগাজী (লিবিয়া) থেকে ত্রিপলী (লিবিয়া)।
র্যাব জানায়, ভূসধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে হতাহতদের আটককৃতরা বাংলাদেশ থেকে বাসে কলকাতা এবং সেখান থেকে বিমানে দিল্লীতে পাঠিয়েছিল। এরপর দিল্লী থেকে বিমানে শ্রীলংকায় পাঠানো হয়। ভুক্তভোগীরা শ্রীলংকায় ওই স্থানের এজেন্টদের তত্ত্ববধানে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করে। পরে ত্রিপলী (লিবিয়া) থেকে বাংলাদেশী এক এজেন্ট কথিত ‘ওকে টু বোর্ড’ ডকুমেন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শ্রীলংকায় এজেন্টদের কাছে পাঠায়ে। শ্রীলংকায় ওই এজেন্টরা ভুক্তভোগীদের ডকুমেন্ট হস্তান্তর করে। এরপর এজেন্টরা ভুক্তভোগীদের বিমানে ইস্তাম্বুল তুরস্কের ট্রানজিট হয়ে ত্রিপলী লিবিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ের মাধ্যমেও লিবিয়ায় পাঠানো হয়। দুবাইয়ে পৌছে তাদের বিদেশী এজেন্টদের তত্ত্বাবধানে ৭/৮ দিন অবস্থান করানো হয়। বেনগাজীতে পাঠনোর লক্ষ্যে বেনগাজী থেকে এজেন্টরা কথিত ‘মরাকাপা’ নামক একটি ডকুমেন্ট দুবাইতে পাঠায়। যা দুবাইয়ে অবস্থানরত বিদেশী এজেন্টদের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ওই ডকুমেন্টসহ বিদেশী এজেন্ট তাদেরকে আম্মান (জর্ডান) ট্রানজিট নিয়ে বেনগাজী লিবিয়ায় পাঠায়। বেনগাজীতে বাংলাদেশী এজেন্ট তাদেরকে বেনগাজী থেকে ত্রিপলীতে স্থানান্তর করে।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, ভুক্তভোগীরা ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি কথিত ‘গুডলাক ভাই’সহ আরো কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে। তাদের ত্রিপলিতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করানো হয়। এ সময়ে ভিকটিমদের স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে চক্রটি। সেখানকার সিন্ডিকেট সমুদ্রপথ অতিক্রমের জন্য নৌ-যান চালনা এবং দিকনির্ণয় যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়ের ওপর নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোররাতে এক সঙ্গে কয়েকটি নৌ-যান লিবিয়া হয়ে তিউনেশিয়া উপকূলীয় চ্যানেলের হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে গমনকালে ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়।