কৃষকের কান্না এবং আড়াই কলম ইংরেজি জানা আমাদের অপরাধসমূহ
লুৎফর রহমান রিটন
আমাদের হতভাগ্য দারিদ্র্যক্লিষ্ট কৃষকদের সত্যিকারের বন্ধু সংখ্যা একেবারেই সীমিত। ওদের সামান্য চাহিদাটুকুও পূরণ হয় না। যে কৃষক শস্য উৎপাদন করে তার ঘরেই অভাব-অনটনের ভয়ংকর দৈত্যের স্থায়ী নিবাস। কৃষককে অভুক্ত রেখে আমরা ভরপেট খাই আর সাফল্যের ঢেকুর তুলি।
পৃথিবীর উন্নত কোনো দেশ তার কৃষককে অবহেলা করে না। আমি এই রচনাটি যে দেশে বসে লিখছি সেই কানাডাতেও কৃষকরা কেউই গরিব নয়। সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষদের চাইতে বরং তারা অনেক অনেকগুণ বেশি ধনী। সারাবছর খেয়ে পড়েও বিপুল অকের টাকা থাকে তাদের সঞ্চয়ে। চাষবাসের জন্য সরকার তাদের জমি দেয়। উৎপাদনের সব উপকরণ পৌঁছে দেয় তাদের নাগালের মধ্যে। সারের জন্য তাদের আন্দোলন করতে হয় না। সার চাওয়ার অপরাধে গুলিতে জীবনও দিতে হয় না। (আর আমরা নিকট অতীতে ১৭ জন কৃষককে গুলি করে মেরেছিলাম ন্যায্যমূল্যে সার চেয়ে মিছিল করার অপরাধে! দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন খালদা জিয়া)।
মহামহিম মন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আর কৃপা লাভের আশায় খোলা আকাশের নিচে প্রখর রৌদ্রতাপ সহ্য করে উদাম গায়ে বসেও থাকতে হয় না কানাডার কৃষকদের। বরং এখানে উল্টোচিত্র। মন্ত্রী আর সরকার কৃতজ্ঞ থাকে কৃষকদের প্রতি। কারণ তারা শস্য উৎপাদন করছেন। এই পরিশ্রমের বিনিময়ে সরকার তাদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করছে সবার আগে। ভর্তুকি মূল্যে কৃষির সব উপকরণ তো সরবরাহ করছেই সেসঙ্গে জোগান দিচ্ছে নগদ টাকার পুরো অঙ্ক। লাগবে এক লাখ আর দেবে তিরিশ হাজার এমন চিন্তা এরা মাথায় আনতেই অভ্যস্ত নয়। যা লাগে সব দিচ্ছি বাবা তুমি শুধু উৎপাদনটা অব্যাহত রাখো। তোমার বাড়ি-গাড়ির সব বিষয় আমরা নিশ্চিত করছি। এমন মনোভাব এদেশের সরকারের।
উৎপাদিত শস্য কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেয় সরকার।
বছর ছয়েক আগে ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপনসূত্রে কমদামে একটা ‘ইউজড্কার’ কিনতে অটোয়া শহর থেকে চল্লিশ মিনিটের ড্রাইভ দূরত্বের একটা কান্ট্রিসাইডে (অনেকটা গ্রামের মতো) গিয়েছিলাম। ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে দেখি এলাহী কারবার। দামি পাথরের বিশাল প্রাসাদের মতো একটা বাড়ি। বাড়ির সামনে দু-তিন হাজার লোকের সমাবেশ করা যায় এমন একটা মাঠ। পেছনেও বিশাল ব্যাকইয়ার্ড। বাড়ির মালিক একজন ফার্মার। তিনি তার সাদা টয়োটা গাড়িটা আমাকে দেখালেন। গাড়ির চাবিটা দিলেন টেস্ট ড্রাইভিংয়ের জন্য। গাড়িটা আমার পছন্দ না হলেও গাড়ির মালিককে আমার খুব পছন্দ হলো। ওর সঙ্গে আলাপ জমে উঠার পর বললাম, তোমার গাড়িটা পছন্দ না হলেও বাড়িটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। বাড়িটা বেচবে কিনা বলো। লোকটা বললো, বাড়িটা বিক্রি করতে পারি যদি তুমি সঠিক মূল্য দাও। আমি বললাম, সঠিক মূল্যই পাবে। লোকটা বললো, এই বাড়িটার বাজার মূল্য আরেকটু বেশি হলেও আমি এটা ফাইভ মিলিয়নেই দিয়ে দেবো তোমাকে। আমি তো অবাক, কান্ট্রিসাইডেই এতো দাম হাঁকাচ্ছো! লাকটা বললো, সেই কারণেই তো হাফ প্রাইস! শহরের ভেতরে হলে এটা টেন মিলিয়নে বিক্রি হতো। জানতে চাইলাম, এতো বিশাল সম্পত্তি নিয়ে তুমি এই গ্রামে পড়ে আছো কেন? লোকটা জবাব দিলো… কারণ আমি একজন কৃষক। ফসল ফলাই। ঠিকমতো ফসল ফলাতে হলে আমাকে জমির কাছাকাছিই তো থাকতে হবে!
বাংলাদেশের কৃষকরা কানাডার এই কৃষকের মতো কোটিপতি হবে সেরকম অলীক স্বপ্ন আমি দেখি না, কিন্তু সে তার ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে সেই আশা তো করতেই পারি, তাই না! কৃষকের পরনে কাপড় থাকবে। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই থাকবে। অসুস্থ হলে সে চিকিৎসা পাবে। কমদামে সে কৃষির সব উপকরণ পাবে এবং নিদেনপক্ষে, একদিনও সে উপোস থাকবে না, বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই পেট ভরে ভাত খেতে পাবে সেটা তো আশা করতেই পারি! আমাদের কৃষক হরতাল করে না। ঝড়-বৃষ্টি-রৌদ্রের দাবদাহ উপলক্ষে একদিনের জন্যও কাজ বন্ধ রাখে না আমাদের কৃষক। ওদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটির দিন নেই। মাসিক স্যালারি নেই। ইনক্রিমেন্ট নেই। ঈদে-পার্বনে বোনাস নেই ওদের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ওরা শস্য উৎপাদন করে। ওরা দরিদ্র আর অশিক্ষিত। অর্থনীতির মারপ্যাঁচ বোঝে না। শাসন বোঝে না শোষণও বোঝে না।
আড়াই কলম ইংরেজি পড়তে লিখতে ও বলতে পারা ধনী আর শিক্ষিত লোকেরা, অর্থাৎ কিনা আমরা, ওদের অশিক্ষা আর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে লুট করে নিই ওদের উৎপাদিত সব শস্য। এমন একটা সিস্টেম বানিয়ে রাখি যে সিস্টেমের কল্যাণে কৃষকের উৎপাদিত শস্য চলে আসে আমাদের হাতে। আমরা সারাবছর সেগুলো খেয়ে খেয়ে মোটাতাজা হই। আর ওরা থাকে অনাহারে-অর্ধাহারে। জীর্ণ-শীর্ণ হাড্ডিসার দেহ ওদের। বছরের পর বছর ধরে অপুষ্টির শিকার হয়ে কণ্ঠ ওদের এমনই ক্ষীণ আর অনুচ্চ হয়ে উঠে যে, প্রতিবাদটাও করতে পারে না ঠিকমতো।
চাইছে ন্যায্য দাম অথচ মনে হয় ভিক্ষে চাইছে! হ্যাঁ ওদের ন্যায্য প্রাপ্যটাকে আড়াই কলম ইংরেজি জানা আমাদের কাছে করুণা আর ভিক্ষে চাওয়াই মনে হয়। আমাদের বর্তমান কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাকের কথা শুনে সেরকমই মনে হলো।
সজ্জন কৃষিবিদ রাজ্জাক সাহেব আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ। নব্বুইয়ের দশকে ধামরাইতে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে অতিথি হয়ে। আমার কৃষিবিদ বন্ধু মেহেরপুরের আবদুল হামিদের কারণেই আমার সেই অনুষ্ঠানে যাওয়া। বিকেলে কলেজ মাঠের বিশাল অনুষ্ঠানে আমার বক্তৃতার সময় বিশেষ করে তরুণ-যুবাদের সমর্থন ও সম্মিলিত উল্লাস ধ্বনিতে বিস্মিত আবদুর রাজ্জাক হামিদ সাহেবকে বলেছিলেন… আমাদের অনুষ্ঠানগুলোয় রিটন সাহেবকে নিয়ে যেতে হবে। না। আমার আর যাওয়া হয়নি তার সঙ্গে আর কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে।
এরপর সময়ের বিবর্তনে তিনি মন্ত্রী হলেন। সাপ্তাহিক ২০০০-এর বর্ষপূর্তির একটি অনুষ্ঠানে দেখা হলো সরকারের নতুন মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। খুব আন্তরিক উচ্চারণে হাস্যোজ্জ্বল তিনি আমাকে তার দফতরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন… একবার এসে দেখে যান মন্ত্রী রাজ্জাককে।
আমার যাওয়া হয়নি। তবে মন্ত্রী হিসেবে তার সাফল্যের খবরে দূর থেকে আমি শুভ কামনা জানিয়েছি নীরবে। আমার প্রিয় রাজ্জাক ভাই দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রীদের তালিকায় নিজের নামটি খোদাই করেননি দেখে খুশি হয়েছি। সময়ের বিবর্তনে রাজ্জাক সাহেব আবারো মন্ত্রীর আসনে। দু’দিন আগে একাত্তর টিভিতে ফারজানা মিথিলার টকশোতে তাকে দেখলাম শামিল হতে। নজরুল ইসলাম খান নামের টাঙ্গাইলের একজন কৃষক এ বছর ধানের ন্যায্য দাম পাবেন না বলে রাগে, দুঃখে, কষ্টে, ক্ষোভে, অভিমানে নিজের ধানক্ষেত আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছেন। ঘটনাটা রাজ্জাক স্যারের এলাকায় বলে, এবং কৃষিমন্ত্রী হিসেবে তার দায় বলে তাকে যুক্ত করা হয়েছিলো সেই অনুষ্ঠানে। প্রতিবাদী কৃষক নজরুল ইসলাম খানের বক্তব্য শুনলাম। জানা গেলো সরকার নির্ধারিত দাম তারা কখনোই পাননি। পান না। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি শস্য কেনে না সরকার। (মাঝখান থেকে তৃতীয় পক্ষ লাভবান হয়।) একজন কর্মকর্তা জানালেন… দুইমাস পরে কেনা হবে ধান। তাহলে এই দু’মাস কৃষকেরা উৎপাদিত ধান নিয়ে কি করবেন? মন্ত্রী সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন… সরকারের কিচ্ছু করার নেই। তারা দেখছেন। আগামীতে সব ঠিক হয়ে যাবে। কোন আগামীতে? খুবই হতাশ হলাম শিক্ষিত কৃষিবিদ কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাক স্যারের কথাগুলো শুনে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃষক ও কৃষিবান্ধব বলেই জানি। কিন্তু তার বর্তমান কৃষিমন্ত্রীকে কৃষকবান্ধব বলে মনে হলো না। রাজ্জাক ভাই, কৃষক না বাঁচলে আপনি কি কৃষিমন্ত্রী থাকবেন? ২. ইদানীং একটা কৃষিভিত্তিক টিভি অনুষ্ঠান কল্পনা করি আমি প্রায়ই। মনে মনে চিত্রনাট্য লিখি। দৃশ্য সাজাই।
দৃশ্য এক. ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান জিরো একশান! একজন গরিব প্রান্তিক কৃষকের ইন্টারভিউ নিচ্ছেন আড়াই কলম ইংরেজি জানা শহুরে আধুনিক ধোপদুরস্ত নাদুসনুদুস উপস্থাপক… আচ্ছা এই যে আপনি এই মৌসুমে এই ফসল ফলিয়েছেন, বাম্পার ফলন, এ বছর আপনার কতো লাভ হবে? গরিব কৃষক : সবকিছু ঠিক থাকলিপর লাভ হবে ধরেন আশি হাজার ট্যাকা। আড়াই কলম ইংরেজি : আ শি হা জা র! বাহ্। গেলো বছর কতো লাভ হয়েছিলো? গরিব কৃষক : গেলো বচ্ছরে বাবা লাভ হইছিলো ধরেন ষাইট-সত্তর হাজার। আড়াই কলম ইংরেজি : ষা ট-স ত্ত র হা জা র! বাহ্।
দৃশ্য দুই. এবার গরিব প্রান্তিক কৃষক ইন্টারভিউ নিচ্ছেন আড়াই কলম ইংরেজি উপস্থাপকের…
গরিব প্রান্তিক কৃষক : আমাগো ইন্টারভিউ বেইচা আপ্নে গেলো বচ্ছরে কয় কুটি ট্যাকা লাভ কর্ছিলেন স্যার? আমার ঘরে খাওন নাই। আর আপ্নে অর্গানিক চাইল ছাড়া ভাত খান না। বাহ্। লজ্জা করে না আপ্নের? আড়াই কলম ইংরেজি : ইয়ে মানে আপনি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করছেন কেন? আমার লাভ লোকসানের হিসাব আপনার কাছে দিতে যাবো কেন আমি? আর আপনি সেটার কি বুঝবেন? গরিব প্রান্তিক কৃষক : না বাবা। বুঝুম না। কিন্তু এইটুক বুইঝা ফালাইছি আপ্নের দামি গাড়ি-বাড়ি আপ্নের পিন্দনের দামি জামা-কাপড় স্যুট-কোট-টাই সব আমার ট্যাকায় কিনসেন। আমার ফসল লুট করেন এই আপ্নেরাই। সূত্র : ফেসবুক