লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মাতৃমৃত্যুহার কমেনি৩১ শতাংশ ক্ষেত্রে কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
তাপসী রাবেয়া : আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস উপলক্ষে মিরপুরে ওজিএসবি হাসপাতলে মর্যাদা ও অধিকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসূতিসেবা অধিকার শীর্ষক এক সভা আয়োজন করে কর্তৃপক্ষ। সভায় নারী ও শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে বাড়ি থেকে হাসপাতালে বা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যাওয়ার পথে বছরে রাস্তায় মারা যান ৫০ জনের বেশি মা। এটি দেশে মোট মাতৃমৃত্যুর ১ শতাংশ। এ তথ্য সরকারের মাতৃস্বাস্থ্য জরিপেও (২০১৬ সালে) উঠে এসেছে। এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করেন স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল মঙ্গলবার দেশে পালিত হয় ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন।
এ বিষয়ে অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন, গর্ভধারণের পরপরই সঠিক পরিকল্পনা নিলে রাস্তায় মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব। কোন হাসপাতালে সন্তান জন্ম দেয়া হবে, বাসা থেকে সেখানে যাতায়াতের ব্যবস্থা কী হবে, তা আগেই ঠিক করে রাখতে হবে। একই সঙ্গে সন্তান জন্ম দেয়ার সময় চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করে রাখা দরকার। এসব বিষয়ে আগে থেকে প্রস্তুতি থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না।
তিনি বলেন, জরুরি সমস্যা নিয়ে কোনো সন্তানসম্ভবা মা হাসপাতালে গেলে তাকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা যাবে না। বাংলাদেশ মাতৃস্বাস্থ্য জরিপ ২০১৬ এর তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ মাতৃমৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। দ্বিতীয় কারণটি খিঁচুনি। এ কারণে ২৪ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যকেেেন্দ্র প্রসব হলে মাতৃমৃত্যু কম হয়। সভায় আরো বলা হয়, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি দুই ঘণ্টার গড়ে অন্তত একজন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। এসব মৃত্যুর ৫৪ শতাংশ হচ্ছে বাড়িতে। ১৪ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১৪ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে। ৬ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে জেলা সদর হাসপাতালে, ৬ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কমিউনিটি ক্লিনিক, এনজিও ক্লিনিক ও অন্যান্য স্থানে ৫ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়। হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঘটনা মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লতিফা শামসুদ্দিন।
৪৭ শতাংশ নারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান জন্ম দেন। সরকারের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, গড়ে ধনী পরিবারের তিনজন মা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান জন্ম দেয়ার সুযোগ পান। গরিব পরিবারের ক্ষেত্রে এই সুযোগ পান একজন। তবে ওই জরিপ বলছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের ক্ষেত্রে ধনী ও দরিেেদ্রর এই পার্থক্য আগের চেয়ে অনেকটাই কমে আসছে। ২০০৭ সালে ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য ছিলো আট গুণ। ২০১১ ও ২০১৪ সালে পার্থক্য কমে হয় যথাক্রমে ছয় ও পাঁচ গুণ।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (২০১৭-১৮) খসড়া প্রতিবেদন বলছে, সমাজের সবচেয়ে দরিদ্রশ্রেণির মাত্র ২৬ শতাংশ মা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের সুযোগ পান। অর্থাৎ তারা হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসব করেন। ধনীদের ক্ষেত্রে এই হার ৭৮ শতাংশ। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনো ৫৩ শতাংশ প্রসব হচ্ছে বাড়িতে। অর্থের অভাব না থাকলেও সচেতনতার অভাবে ধনী পরিবারের সব মা এখনো প্রসবের সময় হাসপাতালে আসেন না। আর দরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে সমস্যা দুটি। একটি অংশের সচেতনতার অভাব। অন্য অংশের অর্থের অভাব। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার জীবিত শিশুর জন্ম হয়েছিলো। আর সরকারের ২০১৬ সালের মাতৃস্বাস্থ্য জরিপ বলছে, দেশে এক লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়। সরকার অবশ্য দাবি করছে সংখ্যাটি আরও কম হবে। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান