জাপানি ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
ইয়াছির আরাফাত : বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা ও বাণিজ্য সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে জাপানের ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার সকালে হোটেল টোকিওর নিউ অটানিতে বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরামের (বিজেবিএফ) বৈঠকে তিনি দুই দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ককে উচ্চতর পর্যায়ে নেয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে জাপানের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। জাপানের ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার নেতত্বে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির উচ্চ প্রশংসা করেন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে নেয়া বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করেন। সূত্র : বিডিনিউজ ও বাংলানিউজ
বিদেশি বিনিয়োগে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অন্যতম উদার রাষ্ট্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষা, উদার ট্যাক্স পলিসি, মেশিনারি আমদানিতে কর রেয়াত সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ। শতভাগ বিদেশি মালিকানা, লভ্যাংশ এবং মূলধনের পূর্ণ প্রত্যাবর্তন সুবিধা দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, কাক্সিক্ষত সেই লক্ষ্যে স্থিতিশীলভাবেই আমরা এগিয়ে চলেছি আমরা। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নপূরণে সঠিক পথেই রয়েছি আমরা। শেখ হাসিনা জানান, তার সরকারের নেয়া সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাপনা, বেসরকারি খাতের জন্য স্থিতিশীল নীতি সহায়তা এবং অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাংলাদেশের সফলতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
এসব কারণেই নমিনাল জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ৪১তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর এভাবে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি শিগগিরই দুই অংকের ঘরে পৌঁছবে বলে আমাদের আত্মবিশ্বাসী। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ নিরীক্ষা সংস্থা প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপারসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের ৩২টি বৃহত্তম ও শক্তিশালী দেশের কাতারে থাকবে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাপক শিল্প বিস্তারের ফলে পাঁচ বছরের মধ্যে রপ্তানি দ্বিগুণ হয়ে ৩৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। দ্য ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশকে দ্রুত বর্ধনশীল সোর্সিং কান্ট্রি, পণ্য উৎপাদন ও বিতরণ হাব এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি হওয়া অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
জাপান এক্সাটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, ভবিষ্যতে জাপানি কোম্পানিগুলো যেসব অঞ্চলে ব্যবসার সম্প্রসারণ করবে তার মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
গত বছর বাংলাদেশে জাপান টোবাকোর ১৪০ কোটি ডলারের বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়ে শেখ হাসিনা জাপানের ব্যবসায়ীদের বলেন, আমরা এ ধরনের আরো বিনিয়োগ দেখতে আগ্রহী। বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান শক্তি উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী বলেন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং দেশি, বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানি বিনিয়োগের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে।
মহেশখালী-মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হাব তৈরির লক্ষ্যে ‘ইনটিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফর লজিস্টিক হাব’ এ জাপান হয়তো সহায়তা করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দুটি সফটওয়্যার পার্কে কাজ শুরু হয়েছে এবং ২৬টি হাইটেক পার্ক তৈরির কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ব্যবসার খরচ, মানবসম্পদ, অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার, বিশ্ববাজারে পণ্যের প্রবেশাধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, বিনিয়োগ সুরক্ষা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিচারে বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগী বিনিয়োগ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক খাতে আমাদের সফলতা বিশ্ববাসীর জানা আছে। আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশ থেকে জাপানে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। আমরা রপ্তানি পণ্যের বহুমূখীকরণ করছি। এজন্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য নতুন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পও বিশ্বের নজর কেড়েছে। ইউরোপের দেশসহ বিশ্বের ১৪টি দেশে বাংলাদেশ থেকে পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজ রপ্তানি হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আরেকটি প্রতিশ্রুতিশীল খাত হলো সফটওয়্যার। দেশের ৮০০ আইটি ও সফটওয়্যার কোম্পানির মধ্যে ১৫০টির বেশি কোম্পানি বিদেশি গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে। ২০ হাজারে বেশি বাংলাদেশি আইটি পেশাদার বিশ্বের নামকরা কোম্পানি যেমন মাইক্রোসফট, ইনটেল, আইবিএম কাজ করছে।
এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি চামড়াজাত পণ্য, কৃষিভিত্তিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য এবং ইলেকট্রনিক গ্যাজেটও বিশ্ব বাজারের নজরে রয়েছে। পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে জাপানের নয়জন ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী বক্তব্য দেন। এদের মধ্যে ছিলেনÑজাপান বাংলাদেশ কমিটি ফর কমার্সিয়াল অ্যান্ড কোপারেশনের চেয়ারম্যান টেরাও আসাদা, জাইকার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, জেত্রোর প্রেসিডেন্ট, সুমিহিতো করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ও সিইও, মিৎসুই অ্যান্ড কোং লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, সোজিৎস করপোরেশনের সিনিয়র ম্যানেজিং এক্সিকিউটিভ অফিসার, মিৎসুবিসি মটরসের ভাইস প্রেসিডেন্ট, হোন্ডা মটরসের ম্যানেজিং অফিসার এবং মারুহিসা করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক, এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাদ কবির। অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামাল, প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ এবং জাপানস এনার্জি ফর নিউ এরার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান