দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার যুদ্ধই সোনালি যুদ্ধ
সোহেল রহমান : আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘জনকল্যাণমুখী বাজেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও অসমতা হ্রাস করে জনগণের জীবনমানে গুণগত পরিবর্তন আনাই আমাদের লক্ষ্য।’
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটোত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রারম্ভিক বক্তব্যে প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যাও দেন প্রধানমন্ত্রী।
উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে আমাদের ‘ভিক্ষুকের জাতি’ বলা হতো, এখন এটা বলা হয় না। গ্রামের জনগণের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি গ্রামকে শহরে পরিণত করা হবে। এ লক্ষ্যে বাজেটে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ নামে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ সাল নাগাদ আমরা ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের স্তর পেরিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, সুখী ও সমৃদ্ধ উন্নত দেশÑসোনার বাংলাদেশ গড়তে আমরা সংকল্পবদ্ধ।
উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একদিকে শ্রমবাজারে বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তির আগমন, অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টি সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছে এবং এর সমাধানে নানাবিধ পদক্ষেপ নিচ্ছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের অবসান ঘটানো হবে।’
এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি মানেই চাকরি দেয়া নয়। শিক্ষিত তরুণদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেয়া হবে। এ জন্য বাজেটে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে ধানের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কৃষকের ধান উৎপাদনে যে ব্যয় হয় এর প্রায় ৬০-৭০ অংশই সরকার আর্থিক প্রণোদনা দেয়। এছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও কৃষক সুবিধা পেয়ে থাকে।
নতুন ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভ্যাট আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে। ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে ছয় স্তর বিশিষ্ট ভ্যাট আইন করা হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা খুশি মনেই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা করবেন বলে আমি আশা করি। পাশাপাশি প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এর ফলে আর ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না।
বাজেটে আর্থিক খাত, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর্থিক খাতের সংস্কারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের কিছু সংশোধনী জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ঋণ খেলাপিদের কিছুটা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যারা স্বেচ্ছা-খেলাপি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে উচ্চ ও চক্রবৃদ্ধি সুদের কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে উৎসাহী হচ্ছে না ও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। সেজন্য আমরা সবসময় চেষ্টা করছি ব্যাংক ঋণের সুদের হার যেন সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। কিন্তু কিছু বেসরকারি ব্যাংক এই নির্দেশ মানছে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সফল না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রশ্নকারী সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খবর নেবেন, পত্রিকার মালিকরা কে কোন্ ব্যাংক থেকে কতো টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং কতো টাকা শোধ করেছেন। যতো মিডিয়া আছে, প্রত্যেকে বলবেন, কোন্ মালিক কোন্ ব্যাংকের কতো টাকা ঋণ নিয়ে কতো টাকা শোধ দেননি। খেলাপি হয়ে নিজেরা হিসাব করলে আমাকে আর প্রশ্ন করতে হবে না।’
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে তেমন তারল্য সঙ্কট নেই। বৃহৎ ঋণগুলোকে আরও নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ ও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ মনিটরিং ব্যবস্থাকে জোরদার করতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারে বেশ কিছু প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। আমরা শেয়ারবাজারে সুশাসন দেখতে চাই। দেশের জন্য একটি শক্তিশালী অর্থনীতির পাশাপাশি আমরা দেখতে চাই একটি বিকশিত পুঁজিবাজার। শিল্প বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সংগ্রহের আদর্শ মাধ্যম হচ্ছে পুঁজিবাজার। এ বিষয়ে আমরা সর্বাত্মক উদ্যোগ নিচ্ছি।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ’ (সিপিডি)-এর পর্যালোচনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু মানুষ আছেন, যারা দেশের কোনো উন্নয়ন দেখতে পান না, তাদের কাছে কোনো কিছু ভালো লাগে না। এটা এক ধরনের ‘মানসিক অসুস্থতা’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিপিডি’র নাম উল্লেখ না করে তিনি আরও বলেন, ‘তারা কী গবেষণা করছে ও দেশের জন্য কী বয়ে আনছেÑতা আমার জানা নেই।’ সম্পাদনা : রেজাউল আহসান