আরেক দফা পিছিয়ে যাচ্ছে পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন
শাহীন চৌধুরী: পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন আরেক দফা পিছিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট অর্থাৎ ৬৬০ মেগাওয়াট উৎপাদনে যাবার কথা থাকলেও পিজিসিবি’র গ্রিড লাইন নির্মানে বিলম্বের কারণে তা পিছিয়ে ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। সম্প্রতি এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের মধ্যে এক সংঘর্ষের ঘটনায় ‘ডাইরেক্টিভ কন্ট্রোল সিস্টেম’ চুরি হয়ে যায়। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এই সিস্টেমটি তৈরি করিয়ে আনা হয়েছিল জার্মান প্রতিষ্ঠান সিমেন্সের কাছ থেকে।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি স্থানান্তর ও স্থাপনের জন্য শক্তিশালী ক্রেনের কোনো বিকল্প নেই। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের কাজে ব্যবহৃত এ রকম অনেরকগুলো ক্রেনের হাইড্রলিক সিস্টেম নষ্ট করে রাখা হয়েছে। ফলে ক্রেনগুলো আর কাজ করছে না। এগুলো মেরামতের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ কারিগর (টেকনিশিয়ান) আনতে হবে। এসব কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন আরেক দফা পিছিয়ে যেতে পারে।
অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতই কয়লাভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও প্রয়োজন কয়েক হাজার ধরণের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ। প্রয়োজন সেগুলো যথাযথ ভাবে স্থাপনে সহায়তাকারী নানা রকম ব্যবস্থা। এগুলো সবই সাজানো গুছানো অবস্থায় ছিল। কাজ হচ্ছিল পুরোদমে। ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের (৬৬০ মেগাওয়াট) আগামী সেপ্টেম্বর থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন এবং ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ১৯ জুনের সংঘর্ষ পরবর্তী পরিস্থিতিতে কবে সেখানে উৎপাদন শুরু করা যাবে তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছেন না।
প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজাইন অনুযায়ী অনেকগুলো যন্ত্রপাতি আলাদা করে তৈরি করিয়ে নিতে হয়। একটি কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি অন্য কেন্দ্রে ব্যবহার করা যায় না। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও এমন অনেক যন্ত্রপাতি লুট হয়েছে যেগুলো আবার সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে আনতে হবে। এটা অনেক সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ কাজ। তাছাড়া কতগুলো যন্ত্রপাতি লুট হয়েছে, কতগুলো নষ্ট হয়েছে, সেগুলোর মোট মূল্য কত তা নির্ণয় করতেও মাসখানেক সময় চলে যাবে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ উদ্যোগের একটি প্রকল্প। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম বৃহৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীন সরকারের পক্ষে সেদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেশিন ম্যানুফ্যাকচারিং করপোরেশন (সিএমসি) মিলে বিসিপিসিএল গঠন করা হয়েছে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনার জন্য। প্রকল্পটিতে দুই দেশের অংশীদারত্ব সমান।
ঢাকা থেকে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার দক্ষিণে নির্মাণাধীন পায়রা সমুদ্র বন্দরের কাছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপিত হচ্ছে। এটিই চালু হওয়ার কথা ছিল দেশের সর্বপ্রথম কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু গত ১৯ জুন রাতে সেখানে কর্মরত অবস্থায় একজন বাংলাদেশী শ্রমিকের দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটিতে কর্মরত বাংলাদেশী ও চীনা কর্মীদের মধ্যে সংঘটিত ব্যাপক সংঘর্ষে পরিস্থিতি বদলে গেছে। ওই সংঘর্ষের সময়ই প্রকল্প এলাকায় লুটপাট, ভাংচুর ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে আহত চীনা কর্মীদের একজন মারা যান।
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১৬ জন বাংলাদেশী কর্মীকে গ্রেপ্তার করে হাজতে নেওয়া হয়েছে। আরও প্রায় ৬০০ কর্মীকে অভিযুক্ত করে স্থানীয় থানায় (পটুয়াখালীর কলাপাড়া) মামলা করা হয়েছে। বাংলাদেশী অন্য কর্মীদের ১৫ দিনের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। চীনা কর্মীরা কর্মরতই আছেন। এই অবস্থায় সেখানকার পরিস্থিতি এখন দৃশ্যত: শান্ত। পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পটিতে সংঘর্ষের সময় প্রায় ৮ হাজার কর্মী কর্মরত ছিল। এরমধ্যে বাংলাদেশী কর্মীর সংখা ছিল চীনা কর্মীর প্রায় দ্বিগুণ। সম্পাদনা : ইকবাল খান