দুধ, তেল, ঘিসহ ৬৮ খাদ্যপণ্যের মান পরীক্ষা নিয়ে বিপরীত অবস্থানে বিএসটিআই এবং ঢাবি ফার্মেসি বিভাগ
স্বপ্না চক্রবর্তী : পাস্তুরিত তরল দুধে ক্ষতিকর জীবাণু থাকে না, কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যেতে পারেÑবিশেষজ্ঞরা এই দাবি করলেও বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে দেশের দুই শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বলছে, তাদের মান পরীক্ষার তালিকায় এন্টিবায়োটিক পরীক্ষা নেই। কিন্তু মানবস্বাস্থ্যের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি মান পরীক্ষা কেন বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা তালিকায় থাকবে না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যায়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি বলছেন, তাদের রিপোর্টে কী সমস্যা আছে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরল দুধ পাস্তুরিত করা হলে জীবাণু ধ্বংস হয়। কিন্তু পাস্তুরাইজেশনের করে এন্টিবায়োটিক ধ্বংস করার ক্ষমতা কোনো কোম্পানির নেই। তাই খামারি পর্যায়ে সচেতন করে গরুকে যখন এন্টিবায়োটিক দেয়া হবে, তখন পাওয়া দুধ বিক্রি না করে ধ্বংস করে দেয়া জরুরি।
এ ব্যাপারে বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক মো. রিয়াজুল হক বলেন, যখন একটি পণ্যের মান পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করি তখন সম্পূর্ণ ফ্রিজ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। বিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগার আন্তর্জাতিকভাবে অ্যাক্রিডেটেড। মান পরীক্ষা নিয়ে কোনো দ্বিমত কারো নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করে কেন এরকম একটি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিলো তা তারা ভালো বলতে পারবে। কোথা থেকে কিভাবে তারা নমুনা পণ্য সংগ্রহ করেছে তাও আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, নিয়মের বাইরে গিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পরীক্ষা করেছে।
এ বিষয়ে পুনরায় জানতে চাইলে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক, আমাদের কাছে এন্টিবায়োটিক জরুরি বিষয়, বেঁচে থাকার জন্য। দুধের সাতটি নমুনার মধ্যে সবগুলোতেই আমরা মানবচিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিনসহ ডিটারজেন্ট, ফরমালিন এবং অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছি। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। নির্ধারিত ফ্যাটের মাত্রাও ঠিক নেই। টোটাল ব্যাকটেরিয়া কাউন্ট ও কলিফর্ম কাউন্ট ছিলো পাস্তুরিত দুধের সবগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। আমাদের সংবাদ সম্মেলনের পর সন্ধ্যায় বিএসটিআই বাজারের ১৫টি দুধের নমুনা পরীক্ষা করে হাইকোর্টকে জানিয়েছে, তারা কোনো দুধে ক্ষতিকর কিছু পায়নি। এটি কিভাবে সম্ভব হলো তা বিএসটিআই বলতে পারবে। যথেষ্ট আর্থিক সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও স্বপ্রণোদিত হয়ে মানবসেবা নিশ্চিতে পরীক্ষাগুলো করেছি। বিএসটিআইয়ের ওপর যদি সাধারণ মানুষের দরদ বেশি থাকে তাহলে তারা বিএসটিআই এর মান নিয়ন্ত্রিত পণ্যই কিনবে। আমাদের কিছু বলার নেই।
এদিকে শীর্ষ দুই প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বে জনমনে তৈরি হয়েছে শংকা। কোন পণ্য মানসম্মত আর কোন পণ্য নি¤œমানের এ বিষয়ে তৈরি হয়েছে দ্বিধা। নগরবাসীর নিত্যভোগ্য পাস্তুরিত তরল দুধ নিয়ে বিএসটিআই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এরকম পাল্টাপাল্টি প্রতিবেদনে গতকাল থেকে রাজধানীতে বিভিন্ন নামী-দামী কোম্পানির পাস্তুরিত তরল দুধের বিক্রি কমে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ থেকে উত্তরণের জন্য খামারি পর্যায়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক ডা. আব্দুন নুর তুষার বলেন, প্রাণী চিকিৎসকরা চিকিৎসা করতে প্রয়োজনে প্রাণীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন। এটা বন্ধ করতে চাইলে এটাও মানতে হবে যে প্রচুর গরু অসুখে মরবে। যেটা করা যেতে পারে সেটা হলো, গরুর অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা চলাকালে দুধ বিক্রি বা সংগ্রহ করে কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করা যাবে না। খামারি ডিটারজেন্ট দিয়ে দুধের পাত্র ধোয়। এক্ষেত্রে তারা খুব বেশি পানি ব্যবহার করে না। তারা সাবান মিশ্রিত একটা চৌব্বাচ্চায় পাত্রটি ডোবায় এবং একবার ধুয়ে নেয়। এতে করে পাত্রে ডিটারজেন্ট থেকে যায়। আমি মনে করি দুধে ওষধু ও ডিটারজেন্ট পাওয়ার দায় খামারিদের। কারণ সে জানে কোন গরুকে ওষুধ দিচ্ছে। সে কম পানিতে পাত্র পরিস্কার করছে। যেহেতু এ্যান্টিবায়োটিক টেস্ট করার সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং কারখানার গেটে এটা করা সম্ভব না, সেহেতু কোম্পানিগুলোর উচিত খামারিদের সচেতন করা। যে সব উপাদান দুধে উপস্থিতির কথা ঢাবির গবেষকরা বলেছেন, সেগুলো মানবদেহের জন্য চরম হুমকি। এন্টিবায়োটিক রোগের উপস্থিতি ছাড়া শরীরে প্রবেশ করলে ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পরবর্তীতে ওই এন্টিবায়োটিক সংশ্লিষ্ট রোগ নিরাময়ে আর কাজ করবে না।
বিষয়টি বিষয়টি নিয়ে এখনি মুখ খুলতে নারাজ বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইসাহাক আলী। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী বলছে না বলছে সেটা তাদের বিষয়। সেটা আমাদের মাথাব্যাথা নয়। আমরা আমাদের কাজটা করে যাচ্ছি। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। তাই আমরা যা বলার আদালতেই বলবো। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান