বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ অধ্যায়ের অবসান
সালেহ্ বিপ্লব : জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রোবার সকাল পৌনে ৮টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিলো ৮৯ বছর। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ প্রায় ৮ মাস ধরে অসুস্থ ছিলেন। দেশে ও দেশের বাইরে কয়েক দফা চিকিৎসার পরও তার অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। গত ২৬ জুন অবস্থার অবনতি ঘটলে বারিধারার বাসভবন থেকে তাকে সিএমএইচ-এ নেয়া হয়। আগামীকাল বিকেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সেনাবাহিনী কবরস্থানে এরশাদকে দাফন করা হবে।
এরশাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রায় সবাই। তারা এরশাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
এরশাদের প্রথম জানাজা গতকাল বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর তার ছোট ভাই ও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, ‘৯১ সাল থেকে প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে আমার ভাই এরশাদ একাধিক আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি দেশ-জাতি ও সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ অবদান রেখেছেন। মানুষ মাত্রই ভুলত্রুটি হয়ে থাকে। উনার কোনও কাজে ভুল হয়ে থাকলে, তার ওপর কোনও ক্ষোভ থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। আমি তার ভাই হিসেবে ক্ষমা চাচ্ছি।’
জানাজা শেষে আইএসপিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এরশাদকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে।
এরশাদের জানাজায় অংশ নেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। জানাজা শেষে এরশাদের মরদেহ কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরশাদের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালী জানান, আজ সোমবার সকাল ১০টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এরশাদের দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বেলা সাড়ে ১১টায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এরশাদের মরদেহ জাতীয় পার্টির কাকরাইল অফিসে নেয়া হবে। তৃতীয় নামাজে জানাজা হবে বাদ আসর বায়তুল মোকাররমে । রাতে সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হবে সাবেক রাষ্ট্রপতির মরদেহ।
আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় হেলিকপ্টারে করে এরশাদের মরদেহ তার নিজ জেলা রংপুরে নেয়া হবে। রংপুর জেলা স্কুল মাঠ অথবা বা ঈদগাহ মাঠে বাদ জোহর চতুর্থ জানাজা হবে। এরপর মরহুম এরশাদের মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। বিকেলে সেনাবাহিনী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরেন। নির্বাচনে প্রার্থী হলেও অসুস্থতার কারণে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেননি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তুমুল আলোচিত-সমালোচিত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। তার জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। বাবা রংপুরের আইনজীবী মকবুল হোসেন ও মাতা মাজিদা খাতুন। এরশাদ ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৬৯-৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এরশাদ পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়েন। ১৯৭৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তখন তাকে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৩ সালে কর্নেল এবং ১৯৭৫ সালে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ওই বছরের আগস্টে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
রাজনীতির পাশাপাশি এরশাদের ব্যক্তিজীবন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ছিলো। তার একাধিক বিয়ে ও প্রেম নিয়ে নানা কাহিনী সেই নব্বই দশক থেকে দেশের মানুষের মুখে মুখে। তবে প্রথম স্ত্রী রওশন এরশাদের সাথেই শেষ পর্যন্ত তার সংসার টিকে ছিলো। রওশন এখন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করছেন। এরশাদ দ্বিতীয়বার তিনি বিয়ে করেন বিদিশাকে। পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়। বিদিশা ও এরশাদের সংসারে রয়েছে একমাত্র ছেলে এরিক এরশাদ। নিজের আত্মজীবনীতে এরশাদ জানিয়েছেন, এরিক ছাড়াও জেবিন, সাদ ও আলম নামে তার তিন সন্তান রয়েছে।
রাজনীতির বাইরে কবিতা চর্চা করেও এরশাদ আলোচিত হন। তিনি অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে কনক প্রদীপ জ্বালো, জীবন সন্ধ্যার সন্ধ্যাতারা, নবান্নে সুখের ঘ্রাণ, কবিতা সমগ্র, যুদ্ধ ও অন্যান্য কবিতা, নির্বাচিত কবিতা (ইংরেজিতে অনূদিত) এবং এক পৃথিবী আগামীকালের জন্যে। কবিতা ছাড়াও এরশাদ আত্মজীবনী লিখেছেন। ২০১৬ সালে আকাশ প্রকাশনী থেকে ‘আমার কর্ম, আমার জীবন’ শীর্ষক এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। হয়েছে ২০১৬ সালে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর এরশাদ ধীরে ধীরে রাষ্ট্রক্ষমতার দিকে অগ্রসর হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন তিনি। দেশে সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএফএম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন এরশাদ।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় পার্টি গঠনের ঘোষণা দেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে এরশাদ পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। স্বৈরাচার হিসেবে অভিহিত হলেও ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন এরশাদ। ৯ বছরের শাসনামলের বেশির ভাগ সময়ই তাকে আন্দোলন মোকাবেলা করতে হয়েছে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি গণঅভুত্থ্যানের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯১ সালে এরশাদ গ্রেফতার হন। কারাগারে থাকা অবস্থায় ৯১ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে বিজয়ী হন। ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। সে সরকার এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করে। একাধিক মামলায় দ-প্রাপ্ত হয়ে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এরশাদ কারাগারে ছিলেন।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জোটগত রাজনীতিতে এরশাদ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে আসেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনের সময় অনেকটা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। দশম জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে।
জোট রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ২০০০ সালে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরে। দলটি তিন ভাগ হয়ে যায়। তবে জাপার মূল অংশটি সব সময় এরশাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন।