মোটরযান ইন্স্যুরেন্সের নামে চলছে প্রতারণা
মেরাজ মেভিজ : আইনী দুর্বলতায় মোটরযান ইন্স্যুরেন্সের নামে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। প্রতি বছর এ খাত থেকে বীমা কোম্পানি প্রিমিয়ার সমৃদ্ধ হলেও অভিযোগ নিষ্পত্তির পরিমাণ খুবই কম। থার্ডপার্টি ইন্স্যুরেন্স অভিযোগেও নানা রকম টালবাহানায় নিষ্পত্তি হয় না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, থার্ডপার্টি ইন্স্যুরেন্সের (তৃতীয়পক্ষ সুবিধা পাবে) অভিযোগে ৯৫ শতাংশ দাবিই রয়েছে অনিষ্পন্ন। এমনকি এর কোন হিসেবই নেই বীমা কোম্পানি নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে। এমন অভিযোগের পক্ষে সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারাও। মাত্র ৫ শতাংশ অভিযোগের নিষ্পত্তি হচ্ছে। বীমা কোম্পানির এমন আচরণে মোটরযান দুর্ঘটনায় নিহত বা আহতদের পরিবারগুলো সবচেয়ে ভুক্তভোগী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৮ সালের কোনো সড়ক দুর্ঘটনাতেই থার্ডপার্টি বীমার টাকা পরিশোধের কোনো নজির পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, বিদ্যমান মোটরযান আইনে কোনো গাড়ি বীমা না করে রাস্তায় চালানো যায় না। বীমা ছাড়া গাড়ি নামালে ট্রাফিক পুলিশের মামলাসহ নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। আইনে গাড়ির জন্য দুই ধরনের বীমার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফার্স্ট এবং থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স। ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্স হলো দুর্ঘটনায় যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হলে বীমা কোম্পানি ওই যানবাহনের ক্ষতিপূরণ দেবে। এই ক্যাটাগরির ইন্স্যুরেন্সের জন্য গ্রাহককে পণ্যমূল্যের ৩ শতাংশ পর্যন্ত প্রিমিয়াম দিতে হয়। এক্ষেত্রে কোনো কারণে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে নানা হয়রানির পর দাবির আংশিক নিষ্পত্তি করে কোম্পানিগুলো।
আর থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স হলো, বীমা করা যানবাহনে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করলে কোম্পানি ওই তৃতীয় ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেবে। এক্ষেত্রে বীমা গ্রহীতা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না। এ ধরনের প্রতিটি ইন্স্যুরেন্সে ৫শ থেকে ৬শ টাকা প্রিমিয়াম নেয় কোম্পানিগুলো। আইনের বাধ্যবাধকতা রক্ষায় এবং প্রিমিয়াম কম হওয়ায়, অধিকাংশ গ্রাহক থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স করেই রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন।
এদিকে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সের বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত কারও দাবি পূরণ করা হয়েছে, এ রকম কোন রেকর্ড দেখাতে পারেনি ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরের কাছেও এ ধরনের কোন রেকর্ড নেই।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাস্তায় গাড়ি নামাতে কিছু আইনি স্বীকৃতির প্রয়োজন হয়। থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সটা তেমনই দায়সারা গোছের। এ ধরনের বীমার কোনো ভিত্তি নেই। বেশিরভাগ দেশেই এটি নেই। ভারতে থাকলেও দেশটি তাদের আসন্ন মোটরযান আইনে ক্ষতির অর্থ বাড়াতে যাচ্ছে। আমরাও এটি উঠিয়ে নেয়ার পক্ষে। এ নিয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছি।’
দেশে বছর বছর এ খাত থেকে আয় বাড়ছে বীমা কোম্পানিগুলোর। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে তার আগের চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে ফাস্ট পার্টি ও থার্ডপার্টি ইন্সুরেন্স মিলিয়ে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা প্রিমিয়ার বেড়েছে বীমা কোম্পানিগুলোর।
বিআইএ’র পরিসংখ্যানে ২০১৭ সালে প্রাইভেট খাতের যানবাহন ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রিমিয়ার এসেছে ৩৪৭ কোটি টাকা। পাবলিক খাত মিলিয়ে ৩৬১ কোটি টাকা। যার বিপরীতে ক্লেইম এসেছে ৯৫ কোটি টাকার। ২০১৬ সালে প্রাইভেট খাতের যানবাহন ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রিমিয়ার এসেছে ৩৩০ কোটি টাকা। পাবলিক খাত মিলিয়ে ৩৪৪ কোটি টাকা। যার বিপরীতে ক্লেইম এসেছে ৮৪ কোটি টাকার। ২০১৫ সালে প্রাইভেট খাতের যানবাহন ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রিমিয়ার এসেছে ৩১৫ কোটি টাকা। পাবলিক খাত মিলিয়ে ৩২৮ কোটি টাকা। যার বিপরীতে ক্লেইম এসেছে ৮৭ কোটি টাকার। ২০১৪ সালে মোটরযান খাতে সাধারণ বীমাসহ মোট ২৮৪ কোটি টাকা প্রিমিয়াম এসেছিলো।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা দুটি প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে ২০১৮ সালে সড়কে মৃত ও আহতের হিসেব ভিন্ন। নিরাপদ সড়ক চাই’র (নিসচা) হিসাবে ২০১৮ সালে সারা দেশে তিন হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৩৯ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ২২১ জন ও আহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান