বন্যা উপদ্রুত এলাকার খাবার-বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট
ইয়াসমিন, দিলওয়ার খান, খাদেমুল বাবুল ও তন্ময় সাহা : দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলীয় ১১ জেলায় পানিবন্দী রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। যেসব জেলায় আগে বন্যার পানি ঢুকেছে সেগুলো থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মানুষ নিজের বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন রাস্তা ও বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রান দেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলছেন স্থানীয়রা।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি)-এর তথ্যমতে, বন্যা উপদ্রুত এলাকার মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ও রোগের ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। বন্যা ও ভূমিধসের কারণে সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কয়েক লাখ মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আটকা পড়েছে। ৬৬ হাজারের বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। খাদ্য ও পরিষ্কার পানি সংকটের সঙ্গে পানিবাহিত রোগ বাড়ার খবরও পাওয়া গেছে। বন্যায় বিস্তীর্ণ কৃষি অঞ্চলে খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্তমানে দেশের জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলে পানি বাড়ছে। অন্যদিকে, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারে এখন বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে ।
নেত্রকোনায় বন্যার পানি কমছে। তবে এখনও প্লাবিত ৩২ টি ইউনিয়ন। শিশুরা ডায়রিয়া আর ঠা-াজনিত রোগ সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে ১২৬ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। ঠা-াজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯ জন। বন্যার্তদের জন্য নেই পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম জানান, ত্রাণ পেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এপর্যন্ত বন্যা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারিভাবে ১২৫ মেট্রিকটন চাউল ১ লক্ষ ৮০ হাজার নগদ টাকা, ৩৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে । বন্যা কবলিত এলাকায় ১০২ মেডিকেল টিম কাজ করছে । একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর, অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি ও কাঁচামালের আমদানি না থাকায় খাদ্যসংকটে অনেকে দিশেহারা। উপজেলার ১৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সিভিল র্সাজন মো. তাজুল ইসলাম খান জানান, বন্যা পরবর্তী রোগ মহামারি আকারে এখনো দেখা দেয়নি।
কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার স্কুল শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বিএসসি বলেন, আমাদের রৌমারী উপজেলার অবস্থা খুবই ভয়ংকর। এখানে ৯৫ ভাগ বাড়ি পানির নিচে। শুধু ডিসি রোড নামে পরিচিত রাস্তাটা শুকনো আছে। মানুষ এখানেই আশ্রয় নিয়েছে। এখানকার অনেক রাস্তাঘাট একেবারেই ভেঙে গেছে। অধিকাংশ মানুষের ঘরে চাল ডাল আছে কিন্তু সেগুলো রান্না করে খাওয়ার অবস্থা নেই।
রৌমারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর রায় বলেন, আড়াই লক্ষ জনসংখ্যার এই উপজেলায় বন্যার পানি কমলেও প্রত্যেকের বাড়িতে পানি আছে। আমরা এখন পর্যন্ত ৮২ মেট্রিকটন চাল, ৬ হাজার খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছি। মানুষ রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে সেখানে গণস্বাস্থ্য থেকে টয়লেট বানিয়ে দিয়েছি। খাবার পানির জন্য টিউবওয়েল বসিয়ে দিয়েছি। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট প্রত্যেক বাড়িতে দেয়া হয়েছে।
জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও শুরু হয়েছে নদী ভাঙন। জেলার অনেক এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌছাঁয়নি বলে অভিযোগ বানভাসীদের। বন্যায় পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলার সাত উপজেলার ৬১ ইউনিয়ন ও সাত পৌরসভায় বন্যাকবলিত প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। পানিবন্দী মানুষরা বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। খাদ্য, শিশু খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের চরম সংকট চলছে। বন্যাকবলিত পানির তোড়ে এলাকার বেশিরভাগ সড়ক ও রেললাইন ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। এক হাজার ১০৪ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। রোপা-আমনের বীজতলা, আউশ ধান, পাট ও সবজিসহ ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ভেসে গেছে হাজার হাজার পুকুরের মাছ। বানভাসীদের জন্য সরকারি ত্রাণ তৎপরতা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সরকারিভাবে ৮৫০ মেট্রিকটন চাল, ১৪ লাখ ৫০ হাজার নগদ টাকা ও চার হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বগুড়ার পানি ধীরে ধীরে কমছে। শহরাঞ্চলের মানুষ ত্রাণ পেলেও দুর্গম চরগুলোতে ঠিকমতো ত্রাণ সামগ্রী পোঁছায়নি। মানুষ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি এবং গো খাদ্যের সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনার দুর্গম চর কাজলা ইউনিয়নের বেনুপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য পুটু মিয়া জানান, এই গ্রামের ১৬০ পরিবার গবাদি পশু নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শনিবার পর্যন্ত তারা কোনো প্রকার ত্রাণ সহযোগিতা পায়নি। বোহাইল ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ জানান, ত্রাণ পৌঁছানো হচ্ছে। কিন্তু মানুষের বড় সমস্যা হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি এবং স্যানিটেশন নিয়ে। বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জানায়, বন্যা কবলিত সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় ৩১ হাজার ৫৮৫ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তিন উপজেলায় দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৩৩৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আরও ৫০০ মেট্রিক টন চাল এবং ১০ হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। সম্পাদনা : সমর চক্রবর্তী, ইকবাল