বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন ভাবনা
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড নিয়ে বাংলাদেশ। উক্ত ভূখ-ে বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে রাজা-রাণী, রাজ্য, জমিদারিসহ নানাকিছু ছিল। কিন্তু আধুনকি রাষ্ট্র কাঠামোর চিন্তা-ভাবনা এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে সেভাবে আসেনি এবং কোনদিন ছিলও না। বর্তমানে আমরা বাংলাদেশ নামক একটি আধুনিক রাষ্ট্রের মালিক। দার্শনিক হেগেল বলেছেন, মানুষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো রাষ্ট্র। তাঁর মতে, মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করুক না কেন, রাষ্ট্র সৃষ্টি মানুষের শ্রেষ্ঠ অবদান। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা একটি রাষ্ট্রের মালিকানা পেয়েছি অনেক পরে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন প্রাক্কালে অনেক কিছু নিয়েই আমরা আলোচনা করবো। এক সময় বঙ্গবন্ধুর সার্ধশত জন্মবার্ষিকী, দ্বিশত জন্মবার্ষিকী আসবে। তবে আমাদের সামনে এবার প্রথম বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বাষির্কীর একটি ভিন্ন তাৎপর্য এবং গুরুত্ব রয়েছে। তা হচ্ছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তৈরির ক্ষেত্রে যারা বঙ্গবন্ধুর সহযোগী ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন করেছেন এবং সর্বোপরি যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এই জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন করা হবে। অর্থাৎ এই বারই তাদেরকে পাওয়া যাবে। বঙ্গবন্ধুর দ্বিশত জন্মবার্ষিকীতে তাদেরকে আর পাওয়া যাবে না। এদিক থেকে এবারের জন্মবার্ষিকী বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। এজন্য নানা কর্মসূচির মধ্যে ডকুমেন্টেশন এর ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধু,মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর কিছু লিখিতভাবে আছে। অনেক কিছু বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে এবং অজানাও রয়েছে নানা ঘটনা। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টির দরকার, তা হচ্ছে পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। সামান্তবাদী, আধা সামান্তবাদী, কৃষিনির্ভর এবং জোতদার ও জমিদারের আওতাভুক্ত একটি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্র তৈরি করে দিলেন বঙ্গবন্ধু। আর একাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যারা নানাভাবে সংশ্লিষ্ট এবং সহযোগী ছিলেন, তাদের কাছে যেতে হবে। তাদের বক্তব্য, অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতিচারণ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যেগুলো দিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা জরুরি। এসব কাজ করার সুযোগ এইবারই রয়েছে। এক সময় তারা আমাদের মাঝ থেকে চলে যাবেন। কারণ এখন অনেকের বয়স পঞ্চাশ এবং ষাটের উর্ধ্ব। বিশ্ব রাজনীতিতে নেলসন ম্যন্ডেলা, মাও সেতুং, মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মা গান্ধীদের মতো নন্দিত নেতাদের অবদান মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই পর্যায়ের নেতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনেক বিশ্ব নেতাদের চেয়ে বেশি। আমরা এখন গণতন্ত্র, সাম্য শোষণহীন সমাজের কথা বলি। বিষয়গুলোর আবেদন শ্বাশত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শন ছিল ভিন্নতর। তিনি সাম্যের নতুন ধারণা দিয়েছেন গণতন্ত্রেরও সংজ্ঞা দিয়েছেন। আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, ‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার’, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ানো হয়। বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন ৭ মার্চের ভাষণে। তিনি উল্লেখ করেছেন, “যদি একজনও সঠিক কথা বলে, আমরা সংখ্যায় যাই হই না কেন, তা মেনে নিব”। লিংকনের গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। বেশির ভাগ লোক যা বলবে সেটাই গণতন্ত্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বেশির ভাগ যা বলেন সেটা গণতন্ত্র নয় এমনকি সবাই মিলে যা বলে সেটাও গণতন্ত্র নয়। তিনি ‘নায্যতার’ উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর এরকম অনেক উদ্ধতি রযেছে। যা একেবারে ইউনিক। বিশ্ব নেতৃত্বের পর্যায়ে যেতে যে ধরনের কথা, বক্তব্য, অনুশাসন, বাচনভঙ্গি থেকে শুরু করে শব্দ চয়ন, সবকিছু মিলিয়ে সত্যিকারের ওই লেভেলের বিশ্ব নেতার জন্মশত বাষির্কী পালন করতে যাচ্ছি আমরা। এইবারই এ উৎসব পালনের সুযোগ আমরা প্রথম পেয়েছি। কারণ এটা আর কখনো আসবে না। কাজেই বঙ্গবন্ধুর এ জন্মশতবার্ষিকীকে বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। আজ আমরা বিশ্বের বুকে সফল বাঙালি জাতি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছি। এক সময় আমরা মধ্যম আয় থেকে ধনীদেশে পরিণত হবো। কিন্তু আমাদের শুরুটা হয়েছিল কিভাবে? দেশ কিভাবে এই পর্যায়ে এলো? এগুলোর পুরোটাই বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হলে বঙ্গবন্ধুর জীবন আলেখ্য সবার আগে জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জন্মশত বার্ষিকী বঙ্গবন্ধুকে জানার বড় সুযোগ। আমরা যে যেখানে থাকি না কেন, প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সবাই মিলে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করতে হবে। এজন্য ডকুমেন্টেশনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এ দিবসটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অগ্রণী। কারণ আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল পর্যায়ে পড়ছে তাদের মনোজগতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসতে হবে। একটি সময় তরুণদের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে মুছে ফেলার নানা মিথ্যা তত্ত্ব দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ঘটনাও ঘটেছে। কাজেই সেখান তরুণ প্রজন্মকে বের করে নিয়ে আসার জন্য তাদের কাছে অধিক তথ্য সরবরাহ করা দরকার। এবার আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এ দিবসটি পালনে নানা কর্মসূচির কথা চিন্তা করা হচ্ছে। আমাদের প্রধান কাজ হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উচ্চ এবং বিশ্বমানের প্রকাশনা করা। ইতোমধ্যে লেখা সংগ্রহের কাজ এগিয়ে চলছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভাবেন, ভালো লিখতে পারেন, তাদের লেখা নিয়ে মানসম্পন্ন একটি সংকলন তৈরি করা হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু উপর মাসব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। এছাড়াও নাট্যকলা বিভাগের আয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেসব নাটক রয়েছে, সেখান থেকে বাছাই করা বা নতুন করে কিছু নাটক মঞ্চায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। সঙ্গীত বিভাগের উদ্যাগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সঙ্গীত আয়োজন করব। যদিও বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই দেশাত্ববোধক এবং মুক্তিযুদ্ধের গান, যেগুলোতে বঙ্গবন্ধুর বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো নিয়ে একাধিক সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারি। তরুণ প্রজন্ম যারা বঙ্গবন্ধুকে ব্লাক আউট করার সময় বেড়ে উঠছে, তাদের মাঝে বিদ্যমান ব্যবধান দূর করার জন্য যা যা করা দরকার, তার সবগুলোই করা হবে। পুরান ঢাকা অর্থাৎ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যে জায়গায় অবস্থিত সেখানে বঙ্গবন্ধু বহুবার নির্বাচন করেছেন। কাজেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত একটি জায়গা। পাড়া মহল্লা অনেকে আছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছেন। তাদেরকে সংশ্লিষ্ট করে কিংবা তাদেরকে নিয়ে এসে এইসব আয়োজন হতে পারে। এছাড়াও অনেক সৃজনশীল চিন্তার মাধ্যমে অভিনবভাবে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা থাকবে।
রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে ডকুমেন্টশন তৈরি করা। এর চেয়ে ভালো হত যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ডকুমেন্টারী নির্মাণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন, মোবাইল ফোন দিয়ে আজকাল ভিডিও করা যায়, উন্নত মানের প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা যায়। কাজেই যারা এই সব কাজে সংশ্লিষ্ট তাদেরকে বলা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর সাথে সংশ্লিষ্ট গুরুত্ববহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সাথে বিভিন্ন জনপদের লোকজন সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের বক্তব্য এবং তাদেরকে নিয়ে ডকুমেন্টশন হতে পারে। আমি একবার সুনামগঞ্জে গিয়ে একটি খেয়াঘাটে যাই। সেখানে এক চা দোকানদার আমাকে বললেন, ‘এখানে বঙ্গবন্ধু বসেছিলেন, কথা বলেছিলেন’। বঙ্গবন্ধুর এই স্মৃতি তুলে ধরার জন্য ঢাকা থেকে আমলাতান্ত্রিকভাবে ক্যামেরা নিয়ে না পৌঁছে বরং উপজেলা, জেলা, বিভাগভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। এভাবে এক পর্যায়ে ৫টি প্রামাণ্যচিত্রকে পুরস্কৃত করা হবে। পর্যায়ক্রমে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে এবং পরিশেষে জাতীয়ভাবে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলো বিভিন্ন জায়গায় মাসব্যাপী প্রদর্শনী করা যেতে পারে। যেভাবেই হোক কাজগুলো করতে হবে। এই দিবস পালনের ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। আমরা যাদেরকে একেবারে আওয়ামী লীগ ঘরানার বলে থাকি, এদের একটি বক্তব্য আছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে দলের বাইরে নানা মানুষ রয়েছে। তারা হয়তো আওয়ামী লীগ করে না কিংবা দলের সাথে সংশ্লিট নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আছে। আমরা যাই করি না কেন তা প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সব স্তরের জনগণের কাছে পৌঁছাবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে। তা হলো বিশ্বাসযোগ্যতা। আমরা যা কিছু উপস্থাপন করব, তার যেন বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে। এটা হওয়ার তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যে লোকটি বলবে কিংবা লিখবে সেবিষয়ে লোকটি বিশেষভাবে অভিজ্ঞ কিনা? এই সব কথা বলার যোগ্যতা তার আছে কিনা? শোনা কথা, নাকি নিজে সোর্স হিসেবে এই কথা বলার যোগ্যতা রাখেন। কিংবা যে কারণে তিনি এই সব কথা বলার যোগ্যতা রাখেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। লোকটি বিশ্বাসযোগ্য লোক হতে হবে। তিনি জীবনে যতকথা বলেছেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতা আছে কিনা? আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যে লোকটি বলবেন, তাকে মানুষ পছন্দ করেন কিনা? এখন যদি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলেন, কিন্তু আগে বিরোধিতা করেছেন, তাহলে মানুষ প্রশ্ন তুলবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদ্যাপনের সাথে যারা সংশ্লষ্ট, তাদের এই সব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। তা না হলে পুরো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়