সবসময় আমি ভবিষ্যতের জন্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে চেয়েছি, বললেন ফজলে হাসান আবেদ
ফাতেমা আহমেদ : বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকের চেয়ারপারসনের পদ থেকে ৮৩ বছর বয়সে অবসরে গেলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। মঙ্গলবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক নৈশভোজ অনুষ্ঠানে দেয়া ঘোষণায় এটি জানানো হয়। ৪৭ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে তিনি ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন। ভবিষ্যতে ব্র্যাককে কোন অবস্থানে দেখার স্বপ্ন দেখেন তিনি, বিদায়ের মুহূর্তে একটি চিঠির মাধ্যমে কর্মীদের সেকথাও জানিয়েছেন। বাংলানিউজ, বাংলা ট্রিবিউন
ঘোষণায় আরও জানানো হয়, চেয়ারপারসনের পদ ছেড়ে এমিরেটাস পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। আর ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদে আসছেন সাবেক ত্ত্বধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ অকপটে বলেন, ‘তরুণ বয়সে এনজিও গড়ে তুলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে কাজ করবো, এরকম কোনও ভাবনা আমার একেবারেই ছিলো না। যথেষ্ট সচ্ছল পরিবেশে আমি বড় হয়েছি। একেবারেই ভিন্ন ধরনের বিলাসী জীবন ছিলো আমার। ব্র্যাকের শুরুটা আমার জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প।’
ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির বিষয়ে চিঠিতে তিনি বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে আমি ব্র্যাকে আমার পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে অনেক ভেবেছি এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি। ব্র্যাকের জন্য এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, যাতে আমার অবর্তমানেও ব্র্যাক তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারে। আমি একটি পেশাদার এবং সুশৃঙ্খল পালাবদল নিশ্চিত করতে চাই।’
চিঠির ভাষ্যানুযায়ী, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির বিষয়টি তার মাথায় আসে ২০০১ সালে যখন তিনি ৬৫ বছর বয়স পূর্ণ করেন। তিনি লিখেছেন, ‘তখন ঠিক করলাম, ব্র্যাকের নেতৃত্ব অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আমি নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। ব্র্যাকের কাজ পরিচালনা করার জন্য তখন নতুন একজন নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ দেয়া হলো। আমি ব্র্যাকের বোর্ড সদস্য হলাম। সে সময় ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন কবীর। তিনি প্রস্তাব করলেন, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতারই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন হওয়া উচিত। তখন থেকেই আমি ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হলাম।’
তিনি বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৮৩ বছর। আমি মনে করি, চেয়ারপারসন হিসেবে ব্র্যাক এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের বোর্ডের সক্রিয় ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াবার এটিই সঠিক সময়। তাই আমি ব্র্যাক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল সুপারভাইজরি বোর্ডের চেয়ারপারসনের পদ থেকে অবসর নিচ্ছি। ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদ আমাকে ব্র্যাকের চেয়ার ইমেরিটাস নির্বাচিত করেছেন। আমি এখনও নিয়মিত অফিসে আসবো। তবে আগামী কয়েক মাস আমি ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল এবং পরিচালনা কাঠামো নির্ধারণের বিষয়ে মনোযোগ দেবো।’
আগামী দিনের ব্র্যাক কেমন হবে বলতে গিয়ে কর্মীদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘ব্র্যাক তার যাত্রা শুরু করেছিলো ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’ এই নাম নিয়ে। এখন কেউ আমাকে যখন জিজ্ঞাসা করেন ব্র্যাক মানে কী? আমি তাদেরকে বলি, ব্র্যাক শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, ব্র্যাক একটি স্বপ্ন, একটি প্রচেষ্টা। এটি এমন একটি পৃথিবীর প্রচেষ্টা, যেখানে সব মানুষ তার সম্ভাবনা বিকাশের সমান সুযোগ লাভ করবেন।’
‘আগামী ১০ বছরে আমরা আমাদের কাজের প্রভাব পৃথিবীর আরও বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে ব্র্যাক যেনো পৌঁছে যায়, সেটিই আমার প্রত্যাশা। আমি স্বপ্ন দেখি ব্র্যাক আগামীতে আরও বড় হবে, নতুন উদ্ভাবন চালিয়ে যাবে এবং নতুন দিনের প্রয়োজনে নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে।’ চিঠিতে এমন মন্তব্য করেছেন তিনি।
ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করলেও তিনি বিশ্বাস করেন ব্র্যাককে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে সব পরিশ্রম করেছেন ব্র্যাকের কর্মীরা। তিনি চিঠিতে লেখেন, ‘আমার একার পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না। জীবনভর যে আস্থা, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, সমর্থন এবং অঙ্গীকার তোমাদের কাছ থেকে আমি পেয়েছি, তার জন্য শুধু ধন্যবাদ দিয়ে তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আমি বোঝাতে পারবো না। তোমরা তোমাদের সীমাহীন সাহস দিয়ে সবসময় আমার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে এসেছো। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাক বোর্ডের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর নিলেও, আমি তোমাদের পাশেই আছি। আগামী দিনগুলোতে আমি ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বিশ্বব্যাপী আমাদের অবস্থান কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে কাজ করে যেতে চাই।’
সরকার, সমমনা পৃষ্ঠপোষক, দাতা এবং সমধর্মী প্রতিষ্ঠানকে পাশে পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘২০০২ সালে আমরা আফগানিস্তানে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কর্মসূচি শুরু করি। এরপর থেকে এশিয়া ও আফ্রিকার ১০টি দেশে আমাদের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়েছি। ব্র্যাক এমন একটি অনন্য সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যার আওতায় রয়েছে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ, মাইক্রোফাইন্যান্স, উচ্চশিক্ষা, বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন কর্মসূচি। এসব কিছু পরিচালিত হচ্ছে একটি অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে।’
ফজলে হাসান আবেদ তার ব্যক্তি জীবনের গল্পও লিখেছেন। ‘আমার গল্প’ নামের অংশে চিঠিতে তিনি তার জীবনের শুরুর সময়ের কথা সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। তিনি শিক্ষাজীবনের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘১৮ বছর বয়সে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আমি লন্ডনে চলে যাই। সেটি ছিলো ১৯৫৪ সাল। সেই থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত টানা ১৪ বছর আমি লন্ডনেই ছিলাম। সেখানে প্রথমে আমি চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে লেখাপড়া শেষ করলাম। তারপর বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে চাকরি করলাম। এক সময় যোগ দিলাম শেল অয়েল কোম্পানির অ্যাকাউন্টস সেকশনে।’ এরপর শেল-এর হয়েই তিনি ফিরে আসেন দেশে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের পাশাপাশি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের পরিচালনা পর্ষদেরও চেয়ারপারসন ছিলেন। ৮৩ বছর বয়সি এ মানুষটির কর্ম দক্ষতায় ব্র্যাক এখন বিশ্বের ‘সর্ববৃহৎ’ এনজিও হিসেবে স্বীকৃত।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরেই ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু হয় ব্র্যাকের। এরপর এশিয়া, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ব্র্যাক ইন্টান্যাশনাল নামে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এই সংস্থাটি।