শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথির মাহাত্ম্য
প্রকৌশলী প্রাঞ্জল আচার্য্য
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিকে তাঁর ভক্তরা ‘জন্মাষ্টমী’ বলতেই বেশী ভালবাসেন। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে, ‘ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহঃ/ অনাদিরাদিগোবিন্দঃ সর্বকারণ কারণম্।।’
অর্থাৎ ‘শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম্ পরমেশ্বর ভগবান। তাঁর শ্রীবিগ্রহ অর্থাৎ শ্রীদেহ সৎ-চিৎ আনন্দঘণ, নিত্য শাশ্বত, চিন্ময় বা জ্ঞানময় এবং চিদানন্দময়। তাঁর কোন আদি নেই। কারণ তিনিই অনাদিরাদি, সব কিছুর উৎস। তিনিই সর্বকারণের আদি কারণ। সকল অস্তিত্বের পরম উৎস।’’ অথর্ব বেদে বলা হয়েছে-
‘যো ব্রহ্মনং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ/ বেদাংশ্চ গাপয়তি স্ম কৃষ্ণ।’ অর্থাৎ ‘যিনি সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মাকে বৈদিক জ্ঞান উপদেশ করেছিলেন এবং পূর্বেই বৈদিক জ্ঞান বিস্তার করেন, তিনিই শ্রীকৃষ্ণ।” তিনি যদি অনাদিরাদিই হবেন, তাহলে দ্বাপর যুগে অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে আবির্ভূত হয়েছিলেন যে কৃষ্ণ তিনি কে? কেনই বা তিনি একজন মানবী মাতা দেবকীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করলেন। এ প্রশ্ন মনে জাগাই স্বাভাবিক। আমাদের মত অর্জুন মহাশয়ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছিলেন, সূর্যদেব বিবস্বানের জন্ম হয়েছিল তোমার জন্মের অনেক পূর্বে। কিভাবে দশ লক্ষ বছর পূর্বে গীতার জ্ঞান তুমি তাকে দিয়েছিলে। ভগবান উত্তরে বলেছিলেন- ‘যদিও আমি জন্ম রহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভুতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।’ ভঃগী (৪/৬)।
শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব এবং অন্তর্ধান সূর্যের মতো। সূর্য যখন আমাদের দৃষ্টি সীমার মধ্যে উদিত হয় তখন আমরা মনে করি সূর্য উদিত হয়েছে। আবার সূর্য যখন আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায় তখন আমরা বলি সূর্য অস্ত গেল। সূর্য কিন্তু সর্বক্ষণই আকাশে বিরাজ করছে। একথাটি আমরা উপলব্ধি করতে পারি না কারণ আমাদের দৃষ্টিইন্দ্রিয়টির ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিত্য। শ্রীকৃষ্ণ কখনো জন্ম গ্রহণও করেন না বা মৃত্যুবরণও করেন না। আমাদের এই ব্রহ্মান্ডে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রতি কল্পে আবির্ভূত হন। ব্রহ্মার একদিন আমাদের ৪৩২ কোটি বছরে এক কল্প। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বয়ংরূপে প্রতি কল্পের সপ্তম মন্বন্তরের ২৮তম চতুর্যুগের মধ্যে দ্বাপর যুগে আবির্ভূত হন।
শ্রীকৃষ্ণ সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান হয়েও কেন দ্বাপর যুগে মানব কুলে আবির্ভুত হয়েছেন তা ভাগবতম্ (১০/৩/৪১) থেকে জানতে পারি- সত্যযুগে পরম বিষ্ণুভক্ত সুতপা দেবী ও প্রভু পৃষ্ণী কঠোর তপস্যার
মাধ্যমে ভগবান বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করেন। ভগবান বিষ্ণু ভক্তদ্বয়ের ভক্তি ও আরাধনায় অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাদেরকে বর দিতে চাইলে, তাঁরা ভগবানকে পুত্র রূপে চাইলেন। ভগবান বর দিলেন ‘তথাস্তু, তোমাদের মনোবাসনা দ্বাপরে পূর্ণ করবো।’ দ্বাপর যুগে কংস দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে বন্দী করলে, প্রিয় ভক্তদ্বয়ের এহেন দুর্দশা সহ্য করতে নাপেরে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভাদ্র মাসের প্রচ- ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেরাতে শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিনী নক্ষত্র সংযুক্ত হয়েছে ঠিক তখনই মথুরায় কংসের কারাগারে শ্রীবিষ্ণু রূপে আবির্ভূত হন। সেই সময় বসুদেব শিশুটিকে চতুর্ভূজ মূর্তিতে প্রকটিত হতে দেখেন। পরণে স্বর্ণউজ্জ্বল পীতবাস, পদ্ম পলাশ লোচন, শংখ-চক্র-গদা-পদ্মধারী, তাঁর গলদেশে পদ্মফুলের মালা। বক্ষ শ্রীবৎস চিহ্নিত ও কৌস্তভমণি শোভিত, সুন্দর কেশধাম যুক্ত, মস্তকে উজ্জল বৈদুর্যমণি খচিত মুকুট শোভা পাচ্ছে। তাঁর গাত্রবর্ণ নবোদিত মেঘমালার মতো উজ্জল শ্যামবর্ণ এবং তাঁর শ্রীঅংগ কর্তকুন্ডল, বাজুবন্দ নানা দিব্য আভরণে ভূষিত। শিশুটির ঐরকম অসাধারণ রূপ দর্শন করে বসুদেব পরম বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। একটিসদ্যজাত শিশু কিভাবে এমন রতœাভরণ- ভ’ষিত দিব্য মূর্তিতে প্রকাশিত হতে পারে। আসলে তিনিতো আর কেউ নন্ তিনি হচ্ছেন- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা মানব জীবনকে সঠিক ও শুদ্ধভাবে পরিচালনা করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত ম্যানুয়েল । সেখানে তিনি বলেছেন- ‘বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে। বাসুদেবঃ সর্বমিতি সঃমহাত্মা সুদুর্লভঃ।’ ভঃগীঃ (৭/১৯)। অর্থাৎ ‘বহু জন্মের পর তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে সর্ব কারণের পরম কারণ রূপে জেনে আমার শরণাগত হন। সেই রূপ মহাত্মা অত্যন্ত দুর্লভ।’ মানুষ বহু বহু জন্মে পূণ্যকর্ম করার ফলে এই জ্ঞান প্রাপ্ত হয় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সর্বকারণের পরম কারণ একথা বুঝতে পারা এবং তা বুঝতে পেরে সকলেরই শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে আত্মনিবেদন করে অতি দুর্লভ মানব জীবন সার্থক করা উচিত। শ্রীকৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রঃ-
‘হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধো দীনবন্ধো জগতপতে/ গোপেশ গোপীকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তুতে।।’
লেখক: উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, ডিপিডিসি, ঢাকা।