প্রভাবশালী ১১ গ্রæপ আবারও ঋণ পুনর্গঠনে সুবিধা পাচ্ছে
জিয়ারুল হক : রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০১৫ সালে গ্রæপগুলো বিশেষ সুবিধায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনর্গঠন করে গ্রæপগুলো। কিন্তু এসব গ্রæপ নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেনি। শর্ত ভঙ্গ করায় আবারও তারা খেলাপি হয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী সেই ১১ গ্রæপকে সুবিধা দিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ২৭ আগস্টের সভায় এমনই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। জাগোনিউজ
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বড় অংশই হাতেগোনা কয়েকটি শিল্প গ্রæপের হাতে আটকে রয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে ১১টি ব্যবসায়ী শিল্প গ্রæপ। বিশেষ সুবিধা নেয়া গ্রæপগুলো হচ্ছেÑবেক্সিমকো গ্রæপ, যমুনা গ্রæপ, থার্মেক্স গ্রæপ, শিকদার গ্রæপ, আবদুল মোনেম লিমিটেড, কেয়া গ্রæপ, এসএ গ্রæপ (এসএ অয়েল রিফাইনারি ও সামান্নাজ), বিআর স্পিনিং, এননটেক্স গ্রæপ, রতনপুর গ্রæপ এবং রাইজিং স্টিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘বড় খেলাপিদের ঋণ পুনর্গঠনে আবারও বিশেষ সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য তারা ঋণ নবায়নের সুযোগ পাবেন। তবে আগের সুবিধাভোগীরা সব ঋণ নবায়ন করতে পরবে না। তারা তলবি ও চলমান ঋণগুলো বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে যেসব ব্যাংক থেকে গ্রæপগুলো ঋণ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদ ঋণ নবায়ন করবে কি-না তার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এরপর ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে জানালে তা যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়া হবে।’
আবারও ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আগে যখন ঋণ পুনর্গঠন করার বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়েছিলো তখনই আমরা বলেছিলামÑযারা সুবিধা নেবে তারা কিভাবে ঋণ শোধ করবে তার একটা অর্থিক পরিকল্পনা নিতে হবে। এরপর যাচাই-বাছাই করে সুযোগ দিতে হবে। ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় খেলাপিদের সুবিধা দিয়েছিলো। কিন্তু সুবিধাভোগীরা শর্ত ভঙ্গ করেছে, ঋণ শোধ করেনি। এখন আবারও খেলাপি হয়ে গেছে। তাই আবার সুবিধা চাচ্ছে। তার মানে একবার সুবিধা দিলে বারবার সুবিধা চায়। এটাই আমাদের বড় সমস্যা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন যারা আবারও ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা চাইছে, তাদের বলতে হবে আগের শর্ত কেন তারা ভঙ্গ করেছে। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি তাদের আর্থিক পরিকল্পনা ও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে। এখন যারা পুনরায় বিশেষ সুবিধা নিবে তাদের নতুন শর্ত জুড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে এককালিন কিছু ঋণ পরিশোধ করে যেন সুবিধা পায় এ ধরনের শর্ত দিতে হবে। এতে করে কিছু অর্থ আদায় হবে।’
সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার বড় খেলাপিদের সুযোগ দেয়া মানে তাদের দুর্বলতা। এভাবে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ নিতে থাকলে এক সময় ঋণের অর্থ পরিশোধ না করার পর্যায়ে চলে যাবে। এটি চলতে থাকলে আগামীতে অন্যরাও সুযোগ নিবে। তাই এখনই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক হতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারি-বেসরকারি প্রায় ২৪টি ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকা সুবিধা নিয়েছিল শিল্প গ্রæপগুলো। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভ‚ত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে বেশ কিছু ব্যাংক নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতিতে পড়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক মূলধনও খেয়ে ফেলছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলো এসব গ্রæপের কাছে জিম্মি হয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে।
জানা গেছে, বিশেষ সুবিধায় বেক্সিমকো গ্রæপ সরকারি-বেসরকারি আটটি ব্যাংকের ৫ হাজার ৬৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে। এরমধ্যে জনতা এক হাজার ৮৪৯ কোটি ১০ লাখ, সোনালী এক হাজার ৭৫ কোটি ৪১ লাখ, ন্যাশনাল ৪৭৭ কোটি ৮৪ লাখ ও এবির ৪৮৩ কোটি, ব্যাংক এশিয়ায় ৩০ কোটি, এক্সিম ২৩৩ কোটি, অগ্রণী ৮০১ কোটি ও রূপালী ব্যাংক ৬৯২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
যমুনা গ্রæপ বিশেষ সুবিধায় ১০ ব্যাংক থেকে নেয়া এক হাজার ৬৮৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ঋণ নবায়ন করে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের ৫৯৮ কোটি টাকা ঋণ নবায়ন করে। ইউসিবিএল ১৭৪ কোটি, আইএফআইসি ১৪১ কোটি, ডাচ-বাংলা ১৭৫ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৮৬ কোটি, সোস্যাল ইসলামীর ৭৩ কোটি, মার্কেন্টাইল ৫১ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ১৮৭ কোটি, অগ্রণীর ৩২ কোটি ও প্রাইম ব্যাংকের ১৬৩ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে।
থার্মেক্স গ্রæপের পক্ষে ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করে জনতা ব্যাংক। যার পরিমাণ ৬৬৬ কোটি টাকা।
শিকদার গ্রæপ তিন ব্যাংকে এক হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা, আবদুল মোনেম লিমিটেড চার ব্যাংকে ৫৭৬ কোটি ৭২ লাখ টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। কেয়া গ্রæপের ৮৭৯ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে পূবালী, সাউথইস্টসহ পাঁচটি ব্যাংক।
এস এ গ্রæপ ৯২৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে ছয়টি ব্যাংক। বিআর স্পিনিংয়ের চার ব্যাংকের ৫৭২ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করেছিল।
এননটেক্স গ্রæপের এক হাজার ৯৪ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে জনতা ব্যাংক। এছাড়া রতনপুর গ্রæপ ৮১১ কোটি টাকা এবং রাইজিং গ্রæপের ৫২২ কোটি টাকা বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠন করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা জারি করা হয়। নীতিমালায় মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয় সর্বোচ্চ ১২ বছর। আর তলবি ও চলমান ঋণ পুনর্গঠন হয় ছয় বছরের জন্য। যেসব শিল্প গ্রæপের ৫০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদেরকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এবং যেসব শিল্প গ্রæপের ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদের ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ খেলাপিদের বিশেষ এ সুবিধার উদ্দেশ্য ছিলো শিল্প গ্রæপগুলোর ঋণ পুনর্গঠন করে লোকসান কাটিয়ে উঠবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলো আয় করে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে। ওই সময় ১১ শিল্প গ্রæপ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। যার কারণে তখন খেলাপি ঋণও কমে যায়। কিন্তু বিশেষ সুবিধা নেয়ার পরও শিল্প গ্রæপগুলো পরবর্তিতে খেলাপি ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করেনি। ফলে পুনর্গঠন করা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় সুদ আসলে ঋণের অংক ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে বড় গ্রæপগুলো অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান