রপ্তানি বাণিজ্য বাড়াতে রাশিয়ার বাজার ধরতে চায় সরকার
জিয়ারুল হক : সরকার ২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানিবাণিজ্য ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্য পূরণে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির চোখ এবার গেছে রাশিয়ার দিকে। তিনি মনে করেন, ‘যেদেশে জনসংখ্যা যতো বেশি, সেদেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদাও ততো বেশি।’ এ কারণেই এবার তিনি বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির জন্য রাশিয়ার বাজার ধরার চেষ্টা করছেন। বাংলাট্রিবিউন
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাতপণ্য, হিমায়িত মাছ, ওষুধ, আলু ও সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে রাশিয়ায় কিছু তৈরি পোশাক, পাট, হিমায়িত চিংড়ি ও আলু রপ্তানি হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ায় উৎপাদিত গম, তুলা, ভুট্টা ইত্যাদি। এছাড়া ইউরিয়া সার, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম, কেমিক্যালস ও খনিজও দেশটির রপ্তানিযোগ্য পণ্য। যা বাংলাদেশ আমদানি করে।
রাশিয়ার বাজার ধরতে গেলে শুধু রাশিয়া নয়, রাশিয়াকে যুক্ত করে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখিস্তান, আরমেনিয়া ও কিরগিস্তানকেও এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কারণ এই পাঁচটি দেশের সমন্বয়ে ইউরেশিয়ান ইকনোমিক ইউনিয়ন (ইইইউ) গঠিত হয়, যা গত ২০১৫ সালের ০১ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এই জোটের সদস্য দেশগুলো একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিলো। বর্তমানে কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস (সিআইএস) নামে পরিচিত। কাজেই রাশিয়ার বাজার ধরতে হলে এই জোটের সম্মতি প্রয়োজন হবে। আর এই জোটের সম্মতি পেলে রাশিয়ার সঙ্গে বাকি চার দেশের বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কর্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ৯ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল নিয়ে চলতি বছরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে মস্কো সফর করেন। প্রতিনিধি দলে বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, ইআরডি, এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর প্রতিনিধিরা সংযুক্ত ছিলেন। মস্কো সফরের বিষয়ে পাঠানো প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ মে সম্মতি দেন।
সূত্র জানায়, ইইইউ’র আওতায় মোট ২ কোটি বর্গ-কিলোমিটার এলাকায় ১৮ দশমিক ২৭ কোটি জনগণ বসবাস করে। এ অঞ্চলের জিডিপি ৫ লাখ কোটি ডলার এবং মাথাপিছু আয় ২৭ হাজার মার্কিন ডলার। বিশ্বের চাষযোগ্য জমির ১৪ শতাংশ এ এলাকার অন্তর্ভুক্ত। বাণিজ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চলতি বছরের ৩১ মে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিশনের সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে স্মারক ‘মেমোরেন্ডাম অব কো-অপারেশন বিটুইন দ্য ইউরেশিয়া ইকনোমিক কমিশন অ্যান্ড দ্য গভর্নমেন্ট পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ স্বাক্ষর করেন। ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিশনের পক্ষে স্মারকটি স্বাক্ষর করেন মন্ত্রী পদমর্যাদার কমিশনের বোর্ডের সদস্য মিজ তাতিয়ানা ভলোভিয়া। বাংলাদেশ ও ইইইউ-এর মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যেই ১৯টি সেক্টর চিহ্নিত করেছে।
এই প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাশিয়া। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার সহযোগিতা ভুলে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। কিছু জটিলতার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য আশানরূপ বাড়েনি। ৫টি দেশ মিলে রাশিয়ায় ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন রয়েছে।’
টিপু মুনশি আরও বলেন, ‘বাণিজ্য লেনদেন এককভাবে কোনও দেশ করতে পারে না। সে কারণেই রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেল চালু হবে। বাণিজ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত হবে। রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, সি-ফুড, আলু, ওষুধ প্রভৃতি পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে।’
বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরের লক্ষ্যে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিশন ২০১৬ সালে একটি খসড়া মেমোরেন্ডাম অব কো-অপারেশন প্রস্তাব করে। প্রস্তাবিত খসড়ার ওপর ব্যবসায়ী সংগঠন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থার অভিমত গ্রহণ করে বিভিন্ন পর্যায়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তাবিত খসড়াটি সংশোধন, পরিমার্জন ও সংশোধন করার পর স্বাক্ষরের লক্ষ্যে চূড়ান্ত করা হয়।
বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি না থাকায় এবং রাশিয়া ইইইউ-এর আওতায় গঠিত কাস্টমস ইউনিয়ন-এর সদস্য হওয়ায় এককভাবে রাশিয়ার পক্ষে বাংলাদেশকে শুল্ক মুক্ত কোটামুক্ত সুবিধা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং, রাশিয়াসহ ইইইউ-এর দেশগুলোয় বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ার লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত স্মারকটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কারণ সহযোগিতা স্মারকের আওতায় একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হবে। যার মূল ভূমিকা কাজ হবে, বাংলাদেশ ও ইইইউ-এর মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে চিহ্নিত ১৯টি সেক্টরের উন্নয়নে কাজ করা। এর ফলে, রাশিয়াসহ ইইইউ-এর দেশগুলোয় বাংলাদেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক ভাইস প্রেসিযেন্ট হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বাণিজ্যমন্ত্রীর রাশিয়া সফর বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রাশিয়ায় তৈরি পোশাক ছাড়াও বাংলাদেশের আলুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের। চাহিদা রয়েছে হিমায়িত মাছের। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ আলু উৎপাদিত হয়। আলু যদি আমরা রপ্তানি করতে পারি তাহলে বাংলাদেশের কৃষক লাবভান হবেন। একইভাবে লাভবান হবেন পাট ও পাটজাত শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। লাভবান হবেন হিমায়িত মৎস্য খাতের ব্যবসায়ীরা। ’
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমরা রাশিয়ার বাজার ধরতে পারলে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় কোনও ব্যাপারই না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে রাশিয়াসহ জোটভুক্ত দেশগুলোর সমর্থন আদায়ে জোর চেষ্টা চলছে।’ পাশপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে বলেও তিনি জানান। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান