মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে জ্বালানি সংকটে পড়বে বাংলাদেশ
মেরাজ মেভিজ ও নূর মজিদ : জ্বালানি তেল আমদানিতে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরবই বাংলাদেশের প্রধান ভরসা। তাই সম্প্রতি দেশটির আরামকোর দুইটি তেল পরিশোধনাগারে স্থাপনায় হওয়া ড্রোন হামলা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনও (বিপিসি)। সৌদি-বাংলাদেশ চুক্তির আলোকে কথা চলছে দুই দেশের উর্ধ্বতন পর্যায়ে। এদিকে দেশীয় বাজারে এখনই এর প্রভাব না পরলেও সৌদি আরবের চলমান সংকট তীব্র হলে বাংলাদেশ জ্বালানি শঙ্কায় পড়বে বলেই মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম অয়েল কর্পোরেশনের গতকালের (মঙ্গলবার) তথ্য উপাত্ত, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও এ খাতের বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আনু মুহাম্মদ এ প্রতিবেদককে বলেন, সাধারণ হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে আমাদের দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু আমার মনে হয় এখনই দেশের বাজারে দাম বাড়ানোর কোন কারণ নেই। এর বড় কারন রিজার্ভ একটি বড় বিষয় আর তাছাড়া আজ যদি কোন এলসি খুলে আজকের দামেই তেল আমদানিও করা হয় সেটা দেশে এসে পৌঁছতে সময় লাগবে।
গতকালের হিসাবে দেশে জ্বালানি তেলের রিজার্ভ নিয়ে বিপিসির বন্টন ও বিপনন বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোরশেদ হোসাইন আজাদ জানান, আজকের হিসাবে (গতকাল) দেশে ক্রুড ওয়েলের (অপরিশোধিত) রিজার্ভ রয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার মেঃটন। এছাড়া ভাসমান (তেলের ট্যাংকার) অবস্থায় দেশের পথে আসছে ৫২ হাজার মে. টন।
এছাড়াও আপাতত সমস্যা তীব্র না হওয়ার প্রধান কারন ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল ও জেট ফুয়েলের পরিশোধিত হিসাবে বেশ কয়েক হপ্তার রিজার্ভ রয়েছে। দেশে এ মুহূর্তে ডিজেলের রিজার্ভ রয়েছে ৫ লাখ ৫২ হাজার মেঃ টন। দৈনিক ১২ হাজার মেঃ টন ব্যবহারের হিসাবে এতে চলবে আরও ৪৬ দিন। দৈনিক ৫৬৫ মে. টন চাহিদার হিসাবে দেশে মজুদ থাকা ১৫ হাজার মেঃ টন অকটেনে চলবে ২৭ দিন। পেট্রোলের হিসাব বলছে ১২ হাজার ৮০ মে. টন মজুদে দৈনিক ৯৯৬ মেঃ টন চাহিদায় চলবে মাত্র ১৩ দিন। আর মজুদ থাকা ৩২ হাজার ৯০০ মে. টন জেট ফুয়েলে দৈনিক ১ হাজার ৩২০ মে. টন হিসাবে চলবে আজ থেকে আরও ২৪ দিন।
বিশেষ অনুসন্ধানে জানা যায়, সৌদির তেল রিফাইনারিতে ড্রোন হামলার পর থেকেই বিপিসি’র বাণিজ্য ও অপারেশন বিভাগ দেশটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। এ ছাড়া দেশের জ্বালানি তেলের বাণিজ্য নীতিতে এখনই এর প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়ে বিপিসি’র চেয়ারম্যান মোঃ সামছুর রহমান বলেন, আসলে এখনই উদ্বিগ্ন হবার কারন নেই। দেশে যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। আরও একটি ট্যাঙ্কার ২৭ তারিখ বন্দরে ভিড়বে। এছাড়া ক্রুডওয়েল আমদানির একটি উৎস আরামকোর (সৌদি আরব) দুই রিফাইনারি, যেখানে হামলা হয়েছে। অন্যটি আরব আমিরাতের অ্যাডনক। আগামী মাসে আমরা অ্যাডনক থেকে তেল কিনব। তাই দেশে মজুদ, আমদানী এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বর্তমান দামেই চলতি মজুদে আগামী অন্তত তিন মাস দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
এদিকে দায়ীত্বশীল অন্য সূত্রে জানা যায়, এর আগেও দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধিতে বেশ কয়েকবার প্রস্তাব করা হলেও সরকার এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দেয়নি। তাই বর্তমান ভর্তুকিতে এখনই কোন প্রভাব পড়বে না।
আনু মুহাম্মদের ভাষ্য, মধ্যপ্রাচ্যের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে প্রধানত আমরা সৌদি আরব থেকেই অপরিশোধিত তেল ক্রয় করে থাকি। আর বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ চাইলেও সম্ভবত ইরান থেকে তেল কিনতে রাজি হবে না। তাই মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবের সংকট তীব্র হলেই কেবল জ্বালানি শঙ্কায় পড়বে বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, আবকেইক বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল পরিশোধনাগার। এবং বৈশ্বিক জ্বালানি শিল্পের হৃদপি-। সেখানে আঘাত আসার কারণে বিশ্ববাজার যে সরবরাহের অনিশ্চয়তায় ভুগছে, তার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া গেছে গত সোমবার বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারের উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে। এদিন মার্কিন অর্থনীতির চালিকাশক্তি নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিট পুঁজিবাজারগুলো অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে পড়ে। সকলখাতের শেয়ারের দাম কমলেও দাম বাড়ে জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা শিল্প সংশি¬ষ্ট মার্কিন কো¤পানিগুলোর।
বিনিয়োগকারীদের মাঝে এখন সবচেয়ে বড় শঙ্কা ইতিমধ্যেই স্থবির হয়ে পড়া বিশ্ব অর্থনীতি জ্বালানির দরবৃদ্ধিতে আরো গতি হারাবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে যে কোন পূর্ণমাত্রার সামরিক সংঘাত এক ধাক্কায় তেলের দর ব্যারেল প্রতি ছাড়িয়ে নিতে পারে ১০০ ডলার। এতো বাড়তি দামে জ্বালানি কিনলে সরকারের সামনে খুব বেশি ভর্তুকি দেয়ার অবকাশ থাকবেনা, ফলে দেশের সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বড় ধাক্কা খেতেই পারে।