সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে গেছে
শোভন দত্ত : মুনাফা কমায় নিরাপদ এই বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। কড়াকড়ি এবং কর বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। বিডিনিউজ
বুধবার জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে সবমিলিয়ে ১১ হাজার ৩০৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এরমধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে সাত হাজার ৬৪৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এ হিসাবেই এই দুই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে নিট সঞ্চয়পত্রের বিক্রির পরিমাণ ছিলো নয় হাজার ৫৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ওই দুই মাসে মোট ১৪ হাজার ৯৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিলো। তা থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিলো পাঁচ হাজার ৯০৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।
এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। মুনাফার উপর করের হার বৃদ্ধির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হবে ধরে নিয়ে এবারের বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য কম ধরেছে সরকার।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্য ধরা আছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাত থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্রে ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। বিক্রির চাপ কমাতে চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একইসঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে কোনো সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না মর্মে শর্ত আরোপ করা হয়।
পরে অবশ্য বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপেক্ষিতে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর আগের মতো ৫ শতাংশ কেটে রাখার ঘোষণা দিয়ে এসআরও জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর।
দুর্নীতি কিংবা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধ করতে এ সব শর্তের পাশাপাশি ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেস তৈরি করে অভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিক্রি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে বড় বিনিয়োগে কঠোর হয়েছে সরকার। এখন আর চাইলেই ভবিষ্যৎ তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ নেই। এখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে কর কমিশনারের প্রত্যয়নপত্র লাগবে।
পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক ফার্মের নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে লাগছে উপকর কমিশনারের প্রত্যয়ন। এসব কারণেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গাবেষক জায়েদ বখত।
২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়। তার আগে পাঁচ বছর মেয়াদী এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্রে থেকে প্রতি মাসে ১ হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেতো।
সুদের হার কমানোর ফলে পাওয়া যেতো ৯১২ টাকা। জুলাই মাস থেকে করের হার বাড়ানোর ফলে পাওয়া যাচ্ছে ৮৬৪ টাকা। তবে পাঁচ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ হলে প্রতি লাখে মাসে ৯১২ টাকাই মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস গস্টে মোট ৫ হাজার ২১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭১৫ কোটি ৩০ হাজার টাকা। এই খরচে সুদ বাবদ চলে গেছে ২ হাজার ২০৫ কোটি ৪০ হাজার টাকা।
এ হিসাবে অগাস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তার আগের মাস জুলাইয়ে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ৬ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয় ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। সুদ বাবদ খাচ হয় ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিলো ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান