মানুষের আয় না বাড়লে কৃষক ফসলের প্রকৃত দাম পাবে না
মতিনুজ্জামান মিটু: দুই হাজার ডলার আয় দিয়ে নিরাপদ ও পুষ্টিমানের খাবার নিশ্চিত করাও যাবেনা। এজন্য কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকরণের কোনো বিকল্প নেই। গতকাল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাজী বদরুদ্দোজা মিলনায়তনে ‘কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন কর্মশালা-২০১৯’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকিকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা গেলে বাজারে কৃষি পণ্যের চাহিদা বাড়বে। মানুষও তার প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারবে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী নিশ্চিত করা যাবে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার। শুধু ধানের উপর আমাদের নির্ভরশীল হলে চলবে না। অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক রীতি-নীতি ও সংস্কৃতিতে কৃষির গুরুত্ব কমেনি।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আমরা জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশকে আমরা অন্তত দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করবো এবং দারিদ্র কমিয়ে আনবো। ২০১৫ সালের মধ্যেই আমরা দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। আপনারা জানেন এই বছর আমরা ধানে উদ্বৃত্ত। কৃষক তাদের ধান বিক্রি করতে পারছে না। ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কম এবং আমরা অনেক চেষ্টা করেও ধানের দাম বাড়াতে পারছি না। আজ সবাই চাচ্ছে কৃষিকে লাভজনক করতে হবে। কৃষি যদি লাভজনক না হয় চাষীরা চাষ করবে কেন? এই ধান বিক্রি করে তাদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ চালাতে হয়। কাজেই কৃষিকে আমাদের বহুমুখীকরণ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের শুধু ধানের উপর নির্ভরশীল হলে হবে না। অন্যান্য ফসল, ফলমূল, সবজি, এগুলো আমাদের করতে হবে। আমরা দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। এখন আমাদের পুষ্টিজাতীয় নিরাপদ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। এই বিবেচনায় আমরা শাক-সবজির উৎপাদন বাড়িয়েছি। ধান বা বিভিন্ন ফসল শুধু বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করলে হবে না। এটাকে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে হবে। ফলমূল, শাক-সবজির মতো উচ্চমূল্যের ফসল আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির অনেক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তা রপ্তানি করতে পারে না। কারণ আমাদের এক্রিডেটেড ল্যাব নেই। তাই তারা মনে করে এগুলো নিরাপদ নয়। বিভিন্ন দেশকে বোঝাতে হবে আমাদের এখান থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি হবে সেগুলো নিরাপদ। তাই বারি’তে আমরা আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব করার চেষ্টা করছি।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাত উদ্ভাবন করেছে। এটা চাষ করে একজন চাষী এক বিঘা জমিতে মাত্র ১৮ দিনে ১ লাখ টাকা লাভ করেছে। তাই আমি বলবো যারা চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, মাদক পাচার, ক্যাসিনো ব্যবসা করে তারা এসব ছেড়ে যদি এই টমেটো চাষ করে বিদেশে রপ্তানি করে তাহলে ক্যাসিনোর চেয়ে বেশি টাকা আয় করতে পারবে।
সম্প্রতি বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এটা একটি মর্মান্তিক ঘটনা। ব্যক্তিগতভাবে আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা এই ধরণের ঘটনা ঘটাবে এটা কাম্য নয়। সারা জাতি এটা নিন্দা করেছে। প্রধানমন্ত্রী কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন যারাই এই ধরণের ঘটনা ঘটাবে সেই দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য। তিনি আরও বলেন, কথা বলার স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই আইন করে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা উচিত হবে না। ছাত্রদের মূল্যবোধের যেন অবক্ষয় না হয় সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
এর আগে কৃষিমন্ত্রী কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের(বারি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান, কীটতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব ল্যাব পরিদর্শন করেন এবং ইনস্টিটিউটের সেমিনার কক্ষের পাশে স্থাপিত বিভিন্ন বিভাগের স্টল পরিদর্শন করেন। গত অর্থ বছর যেসব গবেষণা কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল সেগুলোর মূল্যায়ন এবং অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী বছরের গবেষণা কর্মসূচি তৈরীর উদ্দেশ্যে এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। কর্মশালার কারিগরি অধিবেশন ১৩ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে।
এই গবেষণা পর্যালোচনা তিনটি ধাপে শেষ হয়ে থাকে। আঞ্চলিক গবেষণা পর্যালোচনা, অভ্যন্তরীণ গবেষণা পর্যালোচনা ও কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা। প্রথমে আঞ্চলিক পরে অভ্যন্তরীণ ও সবশেষে কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা ও কর্মসূচি তৈরী করা হয়। কর্মশালার মাধ্যমে গত বছরের গবেষণা কাজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরবর্তী বছরের গবেষণা কর্মসূচি নেওয়া হয়ে থাকে। যে কারণে এই কর্মশালার গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন পর্যায়ের এই কর্মশালায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষক প্রতিনিধি, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় ও আঞ্চলিক কৃষির সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সেই আলোকে গবেষণা কার্যক্রম তৈরী হয়। আঞ্চলিক গবেষণা পর্যালোচনা অঞ্চলভিত্তিক অনুষ্ঠিত হয়। অভ্যন্তরীণ ও কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা বারি সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ২১২টি ফসলের ৫৫৮ টি উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিডসহ), রোগ প্রতিরোধক্ষম ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ প্রতিরোধী জাত এবং ৫২৪ টি অন্যান্য প্রযুক্তিসহ (২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত) মোট ১,০৮২টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে এবং বর্তমানে ২০৭টি ফসলের উপর গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ সব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে দেশে তেলবীজ, ডালশস্য, আলু, গম, সবজি, মসলা এবং ফল ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এসব প্রযুক্তির উপযোগিতা যাচাই বাছাই ও দেশের বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কর্মসূিচ গ্রহণ করাই এ কর্মশালার প্রধান উদ্দেশ্য।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান এমপি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান। সম্মানিত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হিসেবে বক্তব্য দেন, বিএআরআই-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক (অব.) ও এমেরিটাস সায়েন্টিস্ট, এনএআরএস ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা। স্বাগত বক্তব্য দেন বারি’র পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. আব্দুল ওহাব ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন পরিচালক (সেবা ও সরবরাহ) ড. বাবু লাল নাগ।
কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বারি’র অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালকবৃন্দ, পরিচালকবৃন্দ, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বারি’র স্টেকহোল্ডার তথা পলিসিমেকার, জনপ্রতিনিধি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নার্সভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিএডিসি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও কৃষিসংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং বারি’র বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।