দারিদ্র্য দূর করার নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন অভিজিৎ-এস্থার
রেজাউল আহসান : ‘পুওর ইকোনমিকস : অ্যা র্যাডিকাল রিথিংকিং অব দ্য ওয়ে টু ফাইট গ্লোবাল পোভার্টি’ বইয়ে তারা দরিদ্র মানুষের বাজারভিত্তিক ভাবনা তুলে ধরে দারিদ্র্য দূর করার নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। প্রচলিত পদ্ধতিতে দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা কতোটা কাজে লাগছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থবিজ্ঞান পুরস্কার (নোবেল) পাওয়া দম্পতি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার স্ত্রী এস্তার। নোবেল কমিটি অফিশিয়াল বিবৃতিতে বলেছে, ‘ওদের গবেষণা গোটা বিশ্বকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে। মাত্র দুই দশকে ওদের গবেষণা পদ্ধতি উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা বদলে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম মডেল।’
দশ অধ্যায়ের গবেষণা গ্রন্থে তারা বলেছেন, বৈশ্বিক দারিদ্র্যকে একটিমাত্র নিরাকার সমস্যা হিসেবে দেখলে হবে না, বরং অনেকগুলো সমস্যার ফলাফলই দারিদ্র্য। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন দারিদ্র্যের ফাঁদ রয়েছে। তবে এই বাঙালি দম্পতি মনে করেনÑফাঁদ সেখানেই আছে, যেখানে আয় বা সম্পদ বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেখানে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। কিন্তু যাদের বিনিয়োগ করার সামর্থ্য আছে, সেখানে অনেক বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। অন্যদিকে যখন দরিদ্রদের দ্রুত উন্নতি শুরু হয় এবং কিছু লোক দ্রুত ধনী হয়ে ওঠে, সেখানে দারিদ্র্যের কোনো ফাঁদ থাকে না।
গবেষকদ্বয় লিখেছেন, খাদ্য ও পুষ্টির অভাব মানুষকে দীর্ঘকাল দরিদ্র করে রাখে। জন্মের সময় যে শিশুটি পুষ্টিহীন হয়ে জন্ম নেয় এবং জন্মের পরও পুষ্টিহীনতায় ভোগে, সে পড়াশোনার ক্ষেত্রেও খুব একটা ভালো করতে পারে না। ফলে কর্মজীবনেও সে সফল হয় না এবং খুবই কম মজুরি পায়। এক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েদের আয়োডিন ও যুবকদের কৃমিনাশক ওষুধ সরবরাহ করা যেতে পারে। দরিদ্ররাও না খেয়ে থাকলে তা বলতে চায় না। তবে সবার মতোই তারা জীবনের বিরক্তি দূর করতে টিভি, মোবাইল ফোন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে। তারা কম পুষ্টির সস্তা খাবার খায়। শিশুদের পুষ্টির পেছনে যে ব্যয় হবে ওই শিশু বড় হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করার আগে তার সুফল পাওয়া যাবে না, তবু এটি করা জরুরি।
দরিদ্রদের শিক্ষা নিয়ে গবেষণাগ্রন্থে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নয়, শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়াই বড় সমস্যা। গরিব দেশগুলোতে বেসরকারি স্কুলে ভালো পড়াশোনা হয়। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেখানে পড়াশোনা করার সুযোগ কম। ঝরে পড়া প্রতিরোধে গরিব মা-বাবাকে বোঝাতে হবে যে, তার সন্তান পড়াশোনার পেছনে যতো বেশি সময় দেবে, পরবর্তী জীবনে তার আয় ততো বাড়বে।
তারা বলছেন, দরিদ্র শিশুরা অসুস্থ হলে স্কুলে যায় না। শিক্ষার অভাবে তাদের সারাজীবন অল্প আয়ে চলতে হয়। দরিদ্ররা মারাত্মক অসুস্থ হলেই কেবল চিকিৎসা করায়। তখন রোগ সারাতে তাদের অনেক টাকা খরচ করতে হয়। কিন্তু তারা আগে থেকে কম টাকা খরচ করে রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যস্থা নেয় না। স্বাস্থ্য বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাবে গরিব মানুষরা অন্যের কাছে শুনে ওষুধ খায়। এতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও কমে যায়। দরিদ্রদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে টিকা দেয়ার পুরস্কার হিসেবে তাদের বিনামূল্যে খাবার দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বইয়ে।
দরিদ্র দেশগুলোর সরকার দ্রুত উন্নয়নের কৌশল হিসেবে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো গবেষণাতেই এটি প্রমাণিত হয়নি যে, বড় পরিবারের শিশুদের চেয়ে ছোট পরিবারের শিশুরা ভালো থাকে। গবেষণায় বলা হয়েছে, দরিদ্র পরিবারগুলো কন্ট্রাসেপটিভ কিনতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। জন্মহার কমাতে পরিবারের গতিশীলতা না কমিয়ে শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে জন্মহার কমানো সম্ভব। যেসব পরিবারে সন্তান বেশি হবে, তাদের সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা কমিয়ে দেয়ার কথা বলেছেন লেখকদ্বয়।
আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংকট দরিদ্রদের প্রভাবিত করে না উল্লেখ করে তারা লিখেছেন, দরিদ্ররা এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকটে ভোগে। তবে পরিবারের কারও চিকিৎসার পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হলে তারা চরমভাবে পিছিয়ে পড়ে। আর্থিক সংকট দরিদ্রদের বড় ধরনের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা তাদের উৎপাদনশীলতা আরও কমিয়ে দেয়। দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বীমার উদ্যোগ নিলেও গরিব মানুষের পক্ষে নগদ টাকা প্রিমিয়াম গুনে বীমা করা সম্ভব নয়। গরিবের স্বাস্থ্যবীমার প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিতে পারে বলে মনে করেন তারা।
গরিব মানুষের নগদ টাকা জমানোর অভ্যাস তুলে ধরে তারা লিখেছেন, তারা এসব জমানো অর্থ বাড়িঘর তৈরিতে খরচ করে, সুদের কারবারে কাজে লাগায়। গরিব মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে খুব একটা লাভ পায় না। কারণ, অল্প টাকা রাখলে অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ বাবদ অনেক বেশি টাকা কেটে নেয়া হয়। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, লাভজনক ও সহজে সঞ্চয় রাখার সুযোগ পেলে দরিদ্ররা সক্ষমতার চেয়েও বেশি অর্থ সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়।
বেশিরভাগ গরিব মানুষ মধ্যবিত্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখে তাদের সন্তানদের মাধ্যমে। তারা মনে করে ছেলে সরকারি চাকরি করবে, তখন অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিন্তু তারা ক্ষুদ্র কোনো ব্যবসা শুরু করতে আগ্রহী হয় না। লেখকদ্বয় কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরে বলেছেন, গরিবরা সঠিক তথ্য পায় না। তারা এমন কিছু বিশ্বাস করে, যা সত্য নয়। গরিব মানুষদের নিজের জীবন বাঁচাতে অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হয়। সম্পাদনা : মোহাম্মদ রকিব