আমাদের বিশ্ব • আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ৫
নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জনের মৃত্যুদÐ
শাহজালাল ভ‚ঞা ও এমরান পাটোয়ারী : ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ১২ মিনিটে এ রায় পড়ে শোনান। একই রায়ে দÐপ্রাপ্তদের এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এ রায়ে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো সচিত্র ঘটনাপ্রবাহ ব্যবহার করা হয়েছে।
রায় পড়ার শুরুতেই নুসরাত হত্যা মামলায় গণমাধ্যমের ভ‚মিকার প্রশংসা করেন আদালত। আদালতের বিচারক বলেন, গণমাধ্যমের কারণেই এ ভয়াবহ হত্যাকাÐের ঘটনা দেশবাসী জানতে পারে।
রায় পড়তে সময় লাগে ১২ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড। এর আগে ৩ স্তরের নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে আসামিদের কাঠগড়ায় আনা হয়। ৩ মিনিটের মধ্যে আসামিদের কাঠগড়ায় তোলা হয়।
ফাঁসির দÐাদেশপ্রাপ্ত ১৬ আসামি হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদুল আলম, মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহি উদ্দিন শাকিল।
নুসরাত হত্যা মামলায় বাদীপক্ষে ছিলেন বিচারিক আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর হাফেজ আহমেদ, অ্যাডভোকেট আকরামুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট এম শাহজাহান সাজু।
আসামিপক্ষে ছিলেন- হাইকোর্টের আাইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ ও এনামুল হক, ফেনী আদালতের সিনিয়র আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু, কামরুল হাসান, নূরুল ইসলাম, ফরিদ উদ্দিন নয়ন ও মাহফুজুল হক, আহসান কবির বেঙ্গল, সিরাজুল হক মিন্টুসহ ২০ জন আইনজীবী।
রায় শোনার পর অধ্যক্ষ সিরাজসহ অন্যান্য আসামিরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা বলতে থাকে এটা ‘আত্মহত্যা’। আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানো হয়েছে। এসময় তারা নুসরাতের পরিবারকে উচ্চস্বরে বিভিন্ন হুমকি দিতে থাকে। তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবে বলেও চিৎকার করতে থাকে। একপর্যায়ে আসামিরা এ বাদীপক্ষের আইনজীবীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেন। পরে পুলিশি পাহারায় আইনজীবীদের সরিয়ে দেয়া হয়। এর আগে সকালে হাসতে হাসতে আদালতে প্রবেশ করতে দেখা যায় অধ্যক্ষ সিরাজকে। এ মামলার আসামি মাদ্রাসা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীমের মাসহ অন্যান্য আসামির স্বজনরা আদালত প্রাঙ্গণে উচ্চস্বরে কান্নাকাটি শুরু করেন।
রায় শেষে কারাগারে পাঠাতে প্রিজনভ্যানে উঠানোর সময় সিরাজ উদ দৌলাকে অন্য আসামিরা মারধর করে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। তোর কারণে আমাদের ফাঁসি হয়েছে বলেই কয়েকজন আসামি মারতে শুরু করেন প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজকে।
এ সময় আসামি মো. জোবায়ের, জাবেদ হোসেন, মো. শামীম, প্রভাষক আফছার উদ্দিন, হাফেজ আবদুল কাদের কান্নায় চিৎকার করতে থাকেন। পরে পুলিশ পরিস্থিতি শান্ত করে।
মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে নুসরাতের মায়ের করা মামলার ভিত্তিতে অধ্যক্ষ সিরাজকে চলতি ২৭ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১ এপ্রিল শাহাদাত হোসেন শামীম (নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষিপ্ত ছিলেন), নূর উদ্দিন উদ্দিন (অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ), ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের (নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু) ও ইফতেখার উদ্দিন রানা জেলখানায় গিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন।
৩ এপ্রিল শামীম, নূর উদ্দিন, আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজন কারাগারে গিয়ে আবার অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। সিরাজ তখন নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেন আর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালানোর নির্দেশ দেন।
সেদিন বিকালে মাদ্রাসার পাশে একটি টিনশেড কক্ষে আসামিরা বৈঠক করে। নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় ওই বৈঠকেই ।
৬ এপ্রিল সকাল ৭টার পর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে যান শামীম, নূর উদ্দিন ও হাফেজ আব্দুল কাদের। সকাল সোয়া ৯টার মধ্যে আসামিরা পরিকল্পনা অনুযায়ী যার যার অবস্থানে চলে যান। নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী উম্মে সুলতানা পপি তাকে মিথ্যা কথা বলে ছাদে নিয়ে আসে। নুসরাতকে বলা হয়, তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে কারা যেন মারছে। ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয় এবং কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে। নুসরাত অস্বীকৃতি জানালে কেরোসিন ঢেলে দেয় নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে তারা পালিয়ে যায়।
এদিকে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত নিচে নেমে এলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড তার গায়ের আগুন নেভায়। দেহের ৮০ শতাংশজুড়ে আগুনের ক্ষত নিয়ে নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে ঘটনা একইভাবে বর্ণনা করেন বলে অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান) সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। গত ২৮ মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত শেষে মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে। মাত্র ৬১ কার্যদিবসে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। আর মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে পিবিআইয়ের লাগে ৩৩ কার্যদিবস। সম্পাদনা : মুরাদ হাসান ও ফাতেমা আহমেদ