আমাদের বিশ্ব • আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ৪
স্বপ্নের কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরিতে সাফল্যের ঘোষণা গুগলের, আইবিএমের প্রতিবাদ
রেজাউল আহসান ও নূর মাজিদ : কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির দীর্ঘ গবেষণায় বড় এক মাইলফলকে পৌঁছানোর ঘোষণা দিয়েছেন গুগলের গবেষকরা, যার পথ ধরে কম্পিউটার প্রযুক্তিতে রীতিমত বিপ্লব ঘটে যাওয়ার আশা জেগেছে। বিডিনিউজ, আনন্দবাজার, সিএনবিসি, টেক রাডার
বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে গুগলের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, তারা তৈরি করেছেন ‘সিকামোর’ প্রসেসর। সান্তা বারবারায় ল্যাবে তারা একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করেছেন ৩ মিনিট ২০ সেকেন্ডে, যা এখনকার সুপার কম্পিউটারগুলো ১০ হাজার বছরেও শেষ করার ক্ষমতা রাখে না। কম্পিউটিংয়ের এই গতিকে বলা হচ্ছে কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি, যা অর্জন করতে পেরেছেন বলে গুগলের বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। ২০১২ সালে বিজ্ঞানী জন প্রেসকিল ‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি’ শব্দবন্ধটি উদ্ভাবন করেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বিজ্ঞানীরা গুগলের এই ঘোষণাকে তুলনা করছেন ১৯০৩ সালে রাইট ভাইদের প্রথম আকাশে ওড়ার ঘটনার সঙ্গে। অনেক বিশেষজ্ঞ এই সাফল্যকে বলেছেন ‘কিটি হক মুহূর্ত’।
প্রকাশের আগে গুগলের ওই গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় যুক্ত থাকা টেক্সাস ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞানী স্কট অ্যান্ডারসন বলেন, রাইট ভাইরা যে উড়ুক্কুযানে প্রথম উড়েছিলেন, তা সত্যিকার অর্থে ব্যবহারযোগ্য উড়োজাহাজ ছিলো না। কিন্তু তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে উড়োজাহাজ তৈরি সম্ভব, আর তারা তা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন।
এই কোয়ান্টাম মেশিন, যা কিনা বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণার ফসল, তা কাজ করবে আজকের পরিচিত কম্পিউটারের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্নভাবে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, এই যন্ত্র একদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে অথবা এখনকার ফাইল এনক্রিপশন ব্যবস্থাকে সহজেই ভেঙে ফেলতে পারবে।
একটি দেশের কম্পিউটার নেটওয়ার্কের এনক্রিপশন ব্যবস্থা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরকার কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
তবে গবেষকদের কেউ কেউ গুগলের ঘোষণায় এখনই খুব বেশি উদ্বেলিত না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, এরকম একটা কম্পিউটার যে তৈরি করা সম্ভব, সেটা আগে প্রমাণ করতে হবে। আর সেজন্য আরও অনেক পথ যেতে হবে।
গুগলের পাশাপাশি মাইক্রোসফট, ইনটেল, আইবিএমের মতো বড় কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর প্রতিযোগিতা করে আসছে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলো সা¤প্রতিক সময়ে এ খাতে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোতে ৪৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মেধাবি বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা সেখানে কাজ করছেন। এর মাঝেই কোয়ান্টাম ক¤িপউটিং নিয়ে অপেক্ষাকৃত নতুন প্রতিযোগী গুগুল নিজেদের সাফল্য দাবী করলো।
নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে গুগলের গবেষকরা দাবী করেছেন, তাদের তৈরি ‘সিকামোর’ প্রসেসর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসকিলের দেয়া পূর্বাভাস বাস্তবে রূপ দিয়েছে। কিন্তু, এই দাবী তাত্তি¡কভাবে অসম্ভব বলে দাবী করেছে আরেক মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট আইবিএম।
পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক ক¤িপউটার প্রস্তুতকারক আইবিএম তাদের নিজস্ব বøগের একটি পোস্টে এই দাবির প্রতিবাদ জানিয়ে বলছে, গুগুলের দাবি অনেকাংশেই ভুলে ভরা। বিশেষত, সিকামোর প্রসেসরের সক্ষমতা এখনো প্রচলিত ক¤িপউটারের ব্যবহৃত গণনাযন্ত্রের চাইতে উন্নত নয়। অথচ, জন প্রেসকিলের পূর্বাভাসকে সত্যে রূপ দিতে হলে দরকার অধিকতর গণনার সক্ষমতা। পোস্টে সংযুক্ত আনুষ্ঠানিক বিবৃতি বলছে, কোয়ান্টাম শ্রেষ্ঠত্বের সংজ্ঞা নিয়েই গুগল ভুল ব্যাখ্যা করে।
চীন ৪০ কোটি ডলার খরচ করে তাদের কোয়ান্টাম ল্যাব গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র সা¤প্রতিক বছরগুলোতে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির যতোগুলো পেটেন্টের আবেদন করেছে, চীন করেছে তার দ্বিগুণ। ট্রাম্প প্রশাসনও স¤প্রতি এ গবেষণায় ১.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে।
এখনকার কম্পিউটার কাজ করে বিদ্যুতের সুইচ অন অথবা অফ হয়ে। আর কোয়ান্টাম কম্পিউটারে একই মুহূর্তে সুইচ অন এবং অফ দুটোই একসঙ্গে। এটা যেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক আরউইন শ্রয়েডিঙ্গার-এর কল্পিত পরীক্ষার মতন। কোয়ান্টাম যে অদ্ভূতুড়ে, সেটা বোঝাতে শ্রয়েডিঙ্গার ওই কাল্পনিক পরীক্ষার কথা বলেছিলেন। যেখানে ডালাবন্ধ একটা বাক্সের মধ্যে আছে একটা হাতুড়ি, পটাশিয়াম সায়ানাইড ভর্তি শিশি এবং একটা বিড়াল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স কোনও কিছুই নিশ্চিত করে বলে না, তার কাছে সব কিছুই সম্ভাবনা। মানে, হাতুড়ির ঘা বিষ ভর্তি শিশির গায়ে পড়ার সম্ভাবনার কথাই শুধু বলে কোয়ান্টাম। হাতুড়ির ঘা শিশির গায়ে পড়েছে এবং পড়েনি। অর্থাৎ, পটাশিয়াম সায়ানাইড বাক্সের মধ্যে ছড়িয়েছে এবং ছড়ায়নি। ফলে বেড়ালটা মরেছে এবং মরেনি। ডালাবন্ধ অবস্থায় একটার বদলে দুটো বেড়াল। জীবিত ও মৃত। আর বাক্সের ডালা খুললে? তখন একটাই বেড়াল। জীবিত অথবা মৃত। ডালা খোলা মানে কোয়ান্টামের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসা। ডালাবন্ধ অবস্থায় ওই যে ‘অথবা’ দূরে চলে গিয়ে ‘এবং’ দশা, সেটাই কোয়ান্টাম। সেই জন্যই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ইলেকট্রিক সুইচ অন এবং অফ দুটোই একসঙ্গে। সম্পাদনা : মোহাম্মদ রকিব