চামড়াশিল্পে অর্থনৈতিক প্রণোদনা অব্যাহত রাখার ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর
ফাতেমা আহমেদ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চামড়াজাত পণ্য থেকে কাঙ্খিত রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য অর্জনে আগামী ৫ বছর এখাতে আর্থিক প্রণোদনা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প থেকে কাক্সিক্ষত রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আর্থিক প্রণোদনা আরও অন্তত আগামী পাঁচ বছর অব্যাহত থাকবে।’ বাসস, বাংলা ট্রিবিউন
বুধবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘৩য় বাংলাদেশ লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডস ইন্টারন্যাশনাল সোর্সিং শো-২০১৯’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাভারে চামড়া শিল্প নগরীর বর্ধিত প্রকল্পে আন্তর্জাতিক মান ও এলডব্লিউজি সনদ অর্জন উপযোগী কম্পোজিট চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা কারখানা গড়ে তোলার জন্য কমপক্ষে ১৫০ একর জায়গা বরাদ্দ দেবো এবং ইতোমধ্যে আমরা সে জায়গা দেখেছি। সকল রপ্তানি খাতের জন্য সমান সুযোগ ও নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করা হবে। যে সব বৈষম্যমূলক প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করা হবে।’
চামড়া খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে এলএফএমইএবি এবং সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী এই ‘সোর্সিং শো’র আয়োজন করেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প এবং বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন এবং লেদার ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোটার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (এলএফএমইএবি) সভাপতি সাইফুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিদেশি কূটনিতিকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি এবং ক্রেতাগণ, চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি নিয়ে একটি ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশনও পরিবেশিত হয়। আলোচনা পর্ব শেষে বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন এবং স্টল ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘তার সরকার চামড়াজাত দ্রব্য ও পাদুকা রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বিশ্বের আমদানিকারকদের যোগাযোগ ঘটানোর জন্য ‘ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি’র উপর জোর দিচ্ছে। ফলে, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প গত এক দশকে পাট ও পাটজাত পণ্যকে রপ্তানি আয়ে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের খাত হিসেবে পরিণত হয়েছে। এখন এ খাতের আয় তৈরি পোশাকের পরেই জায়গা করে নিয়েছে। গত অর্থবছরে চামড়া খাত থেকে প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘আমাদের ক্রমবর্ধমান কাঁচা চামড়া সরবরাহের পুরোটাই ফিনিশড প্রোডাক্ট তৈরি করে রপ্তানি করতে পারলে আমরা অনায়াসে ২০২২ সালের মধ্যে এ খাত থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করতে সক্ষম হবো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন এবং দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চাই এবং সেজন্য মানবসম্পদ উন্নয়নকে আমরা গুরুত্ব দেই।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বনির্ভরতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের যে স্বপ্ন জাতির পিতা দেখেছিলেন আমরা তা বাস্তবায়নের জন্যই কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে ২০২১ সালে। আর ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী আমরা উদযাপন করবো। আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমি আশা করি, ৩য় বাংলাদেশ লেদার ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার গুডস ইন্টারন্যাশনাল সোর্সিং শো-২০১৯-আয়োজন এ খাতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল বিদেশী ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের দেশের বিভিন্ন শিল্পখাতে বিশেষ করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের শিল্পে বিনিয়োগের আহবান জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগে যে কোন দেশের চাইতে বেশি লাভবান হবেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার সময়ই জাতির পিতা আশাবাদী ছিলেন যে, আমাদের কৃষিজাত পণ্য চা, পাট এবং চামড়া শিল্পকে যথাযথভাবে গড়ে তুলতে পারলে শিল্পায়ন এবং রপ্তানি বাণিজ্যের শক্ত ভিত্তি তৈরি হবে। একইসঙ্গে শক্তিশালী হবে কৃষিখাত। লাভবান হবেন বাংলার কৃষক। কিন্তু জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেমে যায়। পাট, চামড়া শিল্পে ধস নেমে আসে।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের প্রায় সাড়ে ১০ বছরের শাসনামলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের খন্ডচিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘২০০৫-০৬ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি আয় যেখানে ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল তা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৪৬ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে আমদানি ১৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬২ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
বিনিয়োগ, ব্যবসা পরিচালনা ও রপ্তানি বাণিজ্যকে সহজ এবং গতিশীল করতে তার সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সারাদেশে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সুবিধা-সম্বলিত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল আমরা প্রতিষ্ঠা করছি। যার মধ্যে ১২টি অর্থনৈতিক অঞ্চল এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বেশকিছু শিল্প-কলকারখানা সেখানে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি জমির সুরক্ষা করে এই রপ্তানী অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রপ্তানী বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে তার সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা একাধিক টার্মিনাল ও নতুন নৌ-বন্দর স্থাপনের কাজ শুরু করেছি। আঞ্চলিক যোগাযোগ অবকাঠামোর সঙ্গে বাংলাদেশ নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা আমরা সৃষ্টি করেছি।’
সরকারের গত দুই মেয়াদে প্রণোদনা এবং নীতি সহায়তায় পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য কারখানার প্রসার ঘটেছে এবং বিনিয়োগে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘এখন এই খাতের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ আসছে পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য থেকে।’
তিনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং চামড়া শিল্পের আধুনিকায়নে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারে আধুনিক শিল্প নগরীতে এই শিল্প স্থানান্তরেও সরকাররের উদ্যোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের আকার, পণ্যের সমাহার এবং বিপণন সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত চারটি খাতের উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক্সপোর্ট কম্পেটিটিভনেস ফর জবস প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। যার মধ্যে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্প অন্যতম।’
শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, ‘২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য অর্জনে চামড়া ও পাদুকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সকলে এগিয়ে আসবেন।’
বিদেশে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টিতে তার সরকার সবসময় সক্রিয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সবধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন এবং সরকারের পক্ষ থেকেও সম্ভব সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস।
ফিউচার প্রুফ সোর্সিং এই থিম্যাটিক ট্যাগলাইনে এবারের প্রদর্শনীতে ৩০টির বেশি দেশের ক্রেতা ও ব্র্যান্ড প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। থাকবে ১০টি প্যাভিলিয়ন ও ৩০টি স্ট্যান্ডস। যেখানে বিদেশি ক্রেতাদের আকর্ষণে বাংলাদেশে তৈরি করা নানা ধরনের চামড়া ও চামড়াজাতীয় পণ্য প্রদর্শন করা হবে।