ভালো মানের উচ্চশিক্ষা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে
কামরুল হাসান মামুন
প্রায়ই ভাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও দুই-তিনটি যদি সত্যিকারের আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হতো তাহলে কি বাংলাদেশটি আজকের বাংলাদেশের মতো হতো? সত্যিকারের আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কাকে বলে? একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের কী কী গুণ থাকে? প্রথমত, এর বাহ্যিক সৌন্দর্য। একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হবে সব দিক থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে উদাহরণীয়। যেমন এর পরিবেশ। আমাদের দেশে ক্যান্টনমেন্টের পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ থেকে বেটার। অর্থাৎ পরিবেশের দিক থেকেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের কাছে উদাহরণীয় নয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো নান্দনিকতার কোনো ছোঁয়াই নেই। ভবনগুলোর আলাদা আলাদা স্থাপত্য নকশা এবং তাদের সামষ্টিক স্থাপত্যে কোনো কোহেরেন্স নেই, কোনো স্বাতন্ত্র্যতা নেই। এছাড়া রাস্তাঘাট আর গাছগাছড়া মিলিয়ে যে পরিবেশ থাকা উচিত প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা থাকে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান আহরণে ব্যস্ত। এই দুইয়ের মেলবন্ধনে এক অনাবিল পরিবেশ হবে। তারা জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো বলে ক্যাম্পাস মুখরিত করবে না। যখন তখন রাস্তায় উচ্চ ভলিউমে গান বাজিয়ে নৃত্য করবে না। সেখান দিয়ে যানবাহন যাওয়ার সময় কখনো হর্ন বাজাবে না। ক্যাম্পাস পরিপূর্ণ থাকবে ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে মশগুল ছাত্রছাত্রীরা। দেখলেই বোঝা যাবে ছাত্ররা সবাই স্বপ্নে বিভোর। স্বপ্নে বিভোর মানে এই না যে এরা বাস্তব থেকে বিবর্জিত।
তৃতীয়ত, ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য গবেষণা সুবিধা, আবাসিক সুবিধা, লাইব্রেরি সুবিধা, টয়লেট সুবিধা, ক্যাফেটোরিয়ার সুবিধা, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার সুবিধা ইত্যাদি পর্যাপ্ত থাকবে। এছাড়া মানসম্মত ক্লাসরুম ও ট্রান্সপোর্ট সুবিধাও একান্ত জরুরি। উপরের সব কিছু নিশ্চিত করতে হলে অনেক টাকার দরকার। উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রশ্ন হলো এই টাকা আসবে কোথা থেকে। সেটা রাষ্ট্রের চিন্তার বিষয়। মোদ্দা কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে উৎস ব্যাপার নয় টাকা প্রাপ্তিটাই ব্যাপার। গবেষণা মানেই বিশাল অঙ্কের টাকার ব্যাপার। আমরা যদি এসব কিছু নিশ্চিত করে আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে পারতাম তাহলে রাষ্ট্রের অনেক সমস্যাই নাই হয়ে যেতো। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে হলে যেকোনো উপায়েই হোক টাকার যোগান দিতেই হবে। সবচেয়ে ভালো হতো সেই টাকা যোগানের দায়িত্বটা যদি সরকার নেয়। যদি না নেয় তাহলেও উপায় একটি বের করতে হবে। পৃথিবীতে তিনটি মডেলের বিশ্ববিদ্যালয়ই পাওয়া যায় ১. প্রায় সম্পূর্ণ অর্থ রাষ্ট্র অর্থ যোগান দেয়। ২. প্রায় সম্পূর্ণ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ব্যবস্থায় আহরণ করে এবং ৩. এই দুইয়ের মিশ্রণ। আমার কাছে দুইয়ের মিশ্রণ আইডিয়াটা মন্দ লাগে না। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন শুরু হয় তখনকার ছাত্র বেতন ও অন্যান্য ফি যা ছিলো সেটা যদি ডলারে নির্ধারিত হতো তাহলেও তো আজকের অবস্থা থেকে অনেক বেটার হতো। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে উচ্চ শিক্ষার খরচ রাষ্ট্র বহন করে। রাষ্ট্র সেটা জনগণ থেকে ট্যাক্সের মাধ্যম আহরণ করে। আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশে কখনো কখনো সম্পূর্ণ নিজস্ব আয়ে চলে আবার কখনো কখনো নিজস্ব আয় প্লাস সরকারি বরাদ্দ এই দুইয়ের মেলবন্ধনে চলে।
অর্থ সংকুলানের পদ্ধতিটা যেটাই হোক ভালো মানের উচ্চশিক্ষা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল অর্থ বরাদ্দ দিতেই হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা হলো অর্থ। এই অর্থই সব অনর্থের মূল। ছাত্র-শিক্ষকের নৈতিকতার স্খলনের মূলেও এই অর্থ। ছাত্র-শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পেছনেও অর্থই মূল কারণ। আজ যদি শিক্ষকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে যৌক্তিক ভালো মানের বেতন দেয়া হতো তাহলে শিক্ষকদের মাঝে যেকোনোভাবেই হোক অর্থ উপার্জনের নানা ফন্দিফিকির খুঁজতে দেখা যায় সেটার কারণ অর্থ। আবার অর্থ দিলেই যে সবাই ধুয়া তুলসী পাতা হয়ে যাবে ব্যাপারটা তা নয়। তবে অনেকেই হবে। ভালো বেতনের সঙ্গে দায়িত্ববোধ, আত্মসম্মানবোধ ইত্যাদি জড়িত। শিক্ষকরা অর্থ কষ্টে আছে বলেই সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু, পার্ট-টাইম অন্যত্র পড়ানোর ব্যবস্থা চালু, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও এনভেলপ মানি ইত্যাদি চালু হয়েছে যা একসময় ছিলো না। এই দুর্ভিক্ষ চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও নানা রকম পদ্ধতি বের হবে। একসময় হয়তো ব্যাপকহারে প্রাইভেট পড়ানো চালু হবে, লেকচার নোট এবং গাইড বই বিক্রি। এসবই এখন স্কুল-কলেজ লেভেলে চালু আছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসতে হয়তো একটু সময় লাগবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও ধ্বংস হওয়ার আগেই একে ফিরিয়ে আনার এখনই সময় এবং এই শুরুটা করতে হবে কাল থেকেই। ভাবা যায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সান্ধ্যকালীন কোর্স বছরের পর বছর চলছেই। যেই যেই ফ্যাকাল্টিতে চলছে সেই সেই বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও গবেষণা প্রোফাইল ঘেঁটে দেখুন তো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস সংক্ষেপে যাকে আইবিএ বলে এবং যার খ্যাতি ঈর্ষণীয় তাদের ওয়েবপেজ ঘেঁটে দেখুন তো। ওই ফ্যাকাল্টিতে পিএইচডিধারী শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম। আর ওখানে গিয়ে তাদের গবেষণা সম্বন্ধে কিছুই পেলাম না। শুনতে পাই ওই শিক্ষকদের আয়রোজগার সাংঘাতিক ভালো। এসব আয়রোজগার ছেড়ে হয়তো কেউ পিএইচডি করতে যেতে চায় না। আর শিক্ষকদের পোস্ট-ডক? ওটা কারও আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। ওই ফ্যাকাল্টিতে কোনো পিএইচডি প্রোগ্রাম কি চালু আছে? তারা তো আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল? তাদের ওখানে কি কোনো পোস্ট-ডক ফেলো আছে?
শিক্ষকরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে আরও বেশি স্বাধীনচেতা ও প্রতিবাদী হতে পারতো যা দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সচ্ছলতা ছন্দাইনন্দাই করে আসলে হবে না। কারণ স্বাধীন ও নির্ভীক হওয়ার সঙ্গে নৈতিকতার একটি বড় সম্পর্ক আছে। নানা রকম ছন্দাইনন্দাই করে অর্থ উপার্জন করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। নানা রকম অনৈতিকতা বাসা বাঁধে যা বিশ্ববিদ্যালয়ে একান্তই কাম্য নয়। এটা হলে আমরা নৈতিকতা কীভাবে শিক্ষা দেবো? তাই সরকারের উচিত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আরও গভীরভাবে ভেবে এর একটি সমাধান দিন। দেশের সত্যিকারের টেকসই উন্নতি চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। সূত্র : ফেসবুক