আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এশিয়ার নির্ভরতা কমবে
নূর মাজিদ : যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিপুল অনিশ্চয়তায় পড়ে এশিয়ার সরবরাহ ব্যবস্থা ও উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। বাণিজ্য সংঘাত নিরসনের প্রথম দফার আলোচনায় অগ্রগতি আসলেও চিলিতে এপেক সম্মেলন বাতিলের প্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে চুক্তি স্বাক্ষরের দিন নিয়ে নতুন অনিশ্চয়তা। এই অবস্থায় সর্বশেষ কি অর্জন আসবে তা এখনই ¯পষ্ট না হলেও, চীন এবং এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জন্য সুখবর হলো আঞ্চলিক বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের পরিধি প্রতিনিয়তই বেড়ে পশ্চিমা অর্থনীতির ওপর রপ্তানি নির্ভরশীলতা কমার সুযোগ তৈরি হয়েছে এশিয়ার সামনে। বিজনেস টাইমস
নানা খাতের আঞ্চলিক বাণিজ্য তথ্য-উপাত্ত সূত্র বিশে¬ষণে উঠে আসে, এশিয়ার আন্তঃবাণিজ্যের সামষ্টিক অর্থনীতি ধীর গতিতে হলেও নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছে বাণিজ্যযুদ্ধের মাঝেই। ফলে মেড ইন এশিয়া মডেল থেকে এখন মেড ফর এশিয়া মডেলের দিকে ঝুঁকছে এই অঞ্চলের উৎপাদন ব্যবস্থা। পার¯পরিক এই বাণিজ্য নতুন গতি এনেছে আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধিতে, ফলে একটা টেকসই বিকাশের সুযোগও তৈরি হয়েছে। এশিয়ায় চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভারত, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ এখন বাণিজ্যিক মডেলটির সফল উদাহরণ। ফলে আঞ্চলিক জোটগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও বাণিজ্যের আকার আরো বাড়লে, আঞ্চলিক বাণিজ্য আরো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।
মহাদেশটি যদি এই অর্থনৈতিক বাস্তুসংস্থান নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং সামগ্রিকভাবেই পশ্চিমা অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। বিশ্ব অর্থনীতির অন্য পরিম-লে আসা আঘাত থেকেও সুরক্ষিত থাকবে আঞ্চলিক অর্থনীতি। শুধু তাই নয় এক পর্যায়ে উল্টো নিজেদের আর্থিক মঙ্গলের জন্যে এশিয়ার ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়বে পশ্চিমা বিশ্ব।
এই সকল দাবীর স্বপক্ষে এখন তথ্য-উপাত্ত উপাস্থাপন করা যেতেই পারে। বিশেষত, যখন এই অঞ্চলের শীর্ষ অর্থনীতিগুলোর বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার এখন উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপ নয়, বরং তারা এশিয়ার অন্যান্য দেশ। গত বছর এশিয়ার ৫৪ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে একই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে। এই সময়ে বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষিতে মার্কিন শুল্কচাপ এড়াতে এশিয়ার উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈচিত্র আসে। অর্থাৎ, চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেয়া হয়েছে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য দেশে। এরপরেও, সামগ্রিক বাণিজ্যের আকর (তথ্য) অনুসারে, ভোক্তা সক্ষমতা ও চাহিদার পালে হাওয়া লাগায়, আঞ্চলিক বাণিজ্য নতুন গতি লাভ করছে।
ইতিমধ্যেই এশিয়ার ভোক্তারা বিশ্ব অর্থনীতির চেনা মুখটাকেই পরিবর্তন করে ফেলেছেন। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক উৎপাদকেরা এক সময় এই অঞ্চলকে স্বস্তা শ্রমের জন্যেই ব্যবহার করতেন। পশ্চিমা ভোক্তাদের জন্য পণ্য উৎপাদনের আদর্শ স্থান ছিলো এশিয়া। কিন্তু, সেই বাণিজ্যিক দর্শন এখন পরিবর্তিত। কারখানার কাছাকাছি স্থানীয় ভোক্তাবাজার এখন অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তাদের চাহিদাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে উৎপাদনে।
চীনের রপ্তানি বাণিজ্যের দিকে তাকালে এই চিত্র আরো দৃশ্যমান হয়। যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির মোট রপ্তানি চলতি ২০১৯ সালের প্রথমার্ধ নাগাদ ৯ শতাংশ কমে। একইসময়, চীনের সার্বিক বাণিজ্য বাড়ে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার চাহিদার ওপর তার নির্ভরতা অনেকটাই কমিয়ে এনেছে। এইচএসবিসি ব্যাংকের বৈশ্বিক গবেষণা অনুসারে, ২০০৫ সালের পর থেকে সরাসরি বা তৃতীয় কোন দেশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি অর্ধেকের বেশি বা ৭ দশমিক ১ থেকে কমে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ নেমে এসেছে।
তাই বলে এশিয়া যে বাণিজ্য উত্তেজনা থেকে স¤পূর্ণ সুরক্ষিত এমন কথাও সত্য নয়। বরং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বাণিজ্য সংঘাত আরো বিকাশের পথে অন্যতম প্রধান বাঁধা। এই দুটি কারণেই আন্তঃবাণিজ্য ও বিনিয়োগ আশংকাজনক হারে কমেছে। অবশ্য, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন শুল্কটাই প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আঞ্চলিক বাণিজ্য যে বিকশিত হবে সেই বিষয়ে এই অঞ্চলের লগ্নিকারীরা অনেকটাই নিশ্চিত। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসেবে, ভারত বাদে এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর সামগ্রিক বন্ড বাজারের মূল্য এখন ১৫ লাখ কোটি ডলার। এর এক-তৃতীয়াংশ আছে চীনের বাজারে, যা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ বন্ডের বাজার। ব্যাপক আকারের এমন পুঁজি ও ঋণ আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশের পথকে আরো সহজ করবে।