নয় মাসে কর্মহীন ৩০ হাজার পোশাক শ্রমিক, বন্ধ ৫৯ কারখানা
বার্তা ২৪ : চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার পোশাক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এই ৯ মাসে ৫৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর এ সংকট দূর করতে অন্যান্য দেশের মতো পোশাক খাতে বাড়তি প্রণোদনা চায় তৈরি পোশাক খাতের সংগঠনগুলো। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৯৬ শতাংশ বা ১২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩৪ শতাংশ বা ৮.৬ বিলিয়ন ডলার। ফলে পোশাক খাতে নানাবিধ সমস্যার কারণে প্রতিনিয়ত এই খাতের প্রবৃদ্ধি কমছে। বিগত পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৭.৪ শতাংশ ও ইউরোপের বাজারে ৩.৬৪ শতাংশ পোশাকের দরপতন হয়েছে। সর্বশেষ অক্টোবরে পোশাকের সকল আইটেমে মূল্যহ্রাস পেয়েছে। ফলে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেক কম।
স¤প্রতি গার্মেন্টস শিল্পের বিদ্যমান সমস্যাদি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসে পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরা। সেখানে ব্যবসায়ীরা পণ্য রপ্তানিতে ক্লিয়ারেন্স, জাহাজীকরণ, ব্যাংক লোনে উচ্চসুদসহ বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। এসময় ব্যবসায়ীরা ডলারের মূল্য পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানান। তাদের এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। একই সঙ্গে ব্যাংকের উচ্চ সুদের একনেকে আলোচনা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী। বৈঠকে কর আদায়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে গুরুত্ব দেয়ার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। তারা আয়করের পরিধি বাড়ানোর সুপারিশ করেন। যাদের সক্ষমতা রয়েছে, তাদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের বিষয়ে গুরুত্ব দিলে যারা নিয়মিত ট্যাক্স দিচ্ছেন তাদের উপর চাপ কমবে বলেও উল্লেখ করেন তারা।
এ সময় বৈঠকে উপস্থিত অর্থসচিব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যাংক ঋণ ও সুদের বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দেন। আর ট্যাক্সের বাড়তি চাপ কমাতে এ খাতে ট্যাক্স কিছুটা কমানোর কথা জানান এনবিআরের চেয়ারম্যান। সভায় পোশাক খাতে অস্থিরতার জন্য ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কথাও উঠে আসে। ব্যবসায়ীরা জানান, অনেকে কাজের অর্ডার পাওয়ার জন্য দাম কমিয়ে দেন। ফলে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হয়। এসব সমস্যার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলেও বৈঠকে উঠে আসে। জানা গেছে, ভিয়েতনামের জুলাই ও আগস্ট মাসের গড় প্রবৃদ্ধি ১০.৫৪ শতাংশ, ভারতের জুলাই ও আগস্ট মাসের গড় প্রবৃদ্ধি ২.২৫ শতাংশ, পাকিস্তানের জুলাই ও আগস্ট মাসের গড় প্রবৃদ্ধি ৪.৭৪ শতাংশ আর বাংলাদেশের -০.৩৩ শতাংশ। সার্বিকভাবে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চার বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩০.১ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ ও চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা প্রধান ৩০টি পোশাক পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের ১৬টি প্রধান পোশাক পণ্য রয়েছে। এই ১৬টি পণ্যে বিগত ৫ বছরে দেশের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে ১২ শতাংশ, যেখানে ভিয়েতনামের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ শতাংশ।
কর্মহীন শ্রমিক প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছেন অনেক শ্রমিক। তবে কোথাও কোন কর্মী ছাটাই হচ্ছে না। বরং অর্ডার না থাকায় আমরা লাইন বন্ধ করে দিচ্ছি। স্কিল লেভেলের শ্রমিক ছাটাই করে কেউ লোয়ার লেভেলের শ্রমিক নেয় না। তবে শ্রমিকদের বেকার হওয়ার বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। আমাদেরও ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। মেশিনপত্র বিক্রি করে দিয়ে অনেক মালিক বেতন দিচ্ছেন, তাদের কি অবস্থা হবে। কোথায় যাবেন তারা। জানা গেছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে পোশাক খাতে প্রণোদনা হিসাবে ভারত সরকার রপ্তানিমূখী বস্ত্র ও পোশাক খাতের জন্য রেইমবারসমেন্ট অব ট্যাক্সেস অ্যান্ড ডিউটিস ফর এক্সপোর্ট প্রমোশন ( জবরসনঁৎংবসবহঃ ড়ভ ঞধীবং ্ উঁঃরবং ভড়ৎ ঊীঢ়ড়ৎঃ চৎড়সড়ঃরড়হ) স্কিম বাবদ ৫০ হাজার কোটি রূপি বরাদ্দ করেছে এবং এই শিল্পের উপর আরোপিত গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্সেস (এড়ড়ফং ধহফ ঝবৎারপব ঞধীবং) সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করেছে। আর ভিয়েতনাম সরকার তাদের পোশাক শিল্পের জন্য করপোরেট কর প্রথম ৪ বছরের জন্য শতভাগ, পরবর্তী ৯ বছরের জন্য ৫০ ভাগ এবং পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য ১০ ভাগ রেয়াত দিয়েছে। এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় ব্যাংক তাদের পোশাক রফতানিকারকদের জন্য এক্সপোর্ট রিফাইনেন্সিং স্কিম (ঊীঢ়ড়ৎঃ জবভরহধহপরহম ঝপযবসব) এর আওতায় ৭.৫ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করেছে।
এদিকে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানিতে নগদ ৪ শতাংশ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। ফলে বিগত ১০ বছরে নতুন বাজারে রপ্তানি তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি ও বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৫০ শতাংশ বা ৩.৮ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের উন্নয়নে সরকারের কাছে কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে বিজিএমইএ। এরমধ্যে রয়েছে-স্থানীয় পর্যায়ে পোশাক রপ্তানি মূল্য সংযোজনের উপর (রপ্তানি মূল্যের ২৫ শতাংশ) ডলার প্রতি অতিরিক্ত ৫ টাকা বিনিময় হার প্রদান। এ বাবদ প্রয়োজনীয় বরাদ্দের পরিমাণ ৪৬০০ কোটি টাকা (প্রায়)। কোন প্রকার শর্ত বিহীন সকল পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য এক শতাংশ বিশেষ নগদ সহায়তা প্রদান। ০.২৫ শতাংশ হারে হ্রাসকৃত উৎসে কর ১ জুলাই ২০১৯ থেকে কার্যকর করা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে নগদ সহায়তা/ ভর্তুকির উপর উৎসে কর ৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশে ধার্য করা হয়েছে, সহায়তার অর্থকে কোন প্রকার করের আওতামুক্ত রেখে এই ১০ শতাংশ আয়কর সম্পুর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। এছাড়াও সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ও গেজেটকৃত ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের আওতাধীন বিবেচনা যোগ্য ১৩৩টি রুগ্ন শিল্পকে সম্পূর্ণ মূল ঋণ (২৩৮.৪৯ কোটি টাকা) এবং সকল আরোপিত ও অনারোপিত সুদ ও কস্ট অব ফান্ডসহ সকল চার্জ মওকুফ করা। বিপর্যস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের সুরক্ষার জন্য ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের মেয়াদ দ্বিগুণ করা এবং বিশেষ ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানের প্রস্তাবনা দিয়েছে বিজিএমইএ। কেএম নাহিদ। মোহাম্মদ রকিব।