সংঘাতের অভিশাপে বিবর্ণ ইরাকের আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র
বাংলানিউজ : ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে দেশটির আনবার প্রদেশে অবস্থিত হাব্বানিয়া ট্যুরিস্ট ভিলেজ। এটি ফ্রান্সের সাগরঘেঁষা একটি গ্রামের আদলে সাজানো হয়েছিল। হ্রদের তীরে বানানো হয়েছিল নানা রংয়ের ঘর। যাত্রা শুরুর দশকে ইরাকে ছুটি কাটানোর জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে ওঠার কারণে ফুলেফেঁপে উঠেছিল ট্যুরিস্ট ভিলেজটির কোষাগার। এতে ছিল সুদৃশ্য এবং নানা সুবিধা সম্বলিত ৩০০টি রুম আর ৫০০ বাংলো।
ধীরে ধীরে ছুটি কাটানোর জন্য জনপ্রিয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এ ভিলেজে স্থানীয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, তারকারা ছুটি কাটাতে আসতেন। বিশেষ করে ছুটি কাটাতে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং তার পরিবারের প্রিয় গন্তব্যও ছিল এটি। তাদের পছন্দের ‘হোয়াইট ভিলা’ নামে পরিচিত স্বতন্ত্র বাংলোটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
অতিথিদের আপ্যায়নে থাকতো দেশি এবং বিদেশি বিভিন্ন পদের রান্না। সন্ধ্যায় জ্বলতো মোমবাতি, টেবিলে বিছানো থাকতো সাদা লিলেন কাপড়। এখানেই শেষ নয়! অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য বিদেশি শিল্পিরা সংগীত পরিবেশন করতেন গভীর রাত অবধি।
তখন নতুন বছর উদযাপন করতে মানুষ একমাস আগে থেকে রুম বুক করে রাখতো এ ভিলেজে। সেসময়ের জনপ্রিয় মিশরীয় অভিনেত্রী সাদ হুসনি এবং বিখ্যাত ইরাকি গায়ক কাদিম আল শাহির ছিলেন এখানকার নিয়মিত অতিথি।
হাতে থাকা একটি বক্সের ছবির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গর্বের সুরে হামেদ সালামা বলেন, ‘ইরাকের সব গায়ক যারা এখন জনপ্রিয়, তাদের শুরু এখান থেকেই। আর যারা বিখ্যাত হতে চাইতেন, তারা এখানে আসতেন।’
বাগদান, বিয়ে এবং হানিমুনের জন্য ইরাকিদের কাছে এটি ছিল অন্যতম গন্তব্য। প্রতি সপ্তাহে এখানে অনুষ্ঠিত হতো সুন্দরী প্রতিযোগিতা। বিজয়ীদের জন্য থাকতো চিত্তাকর্ষক সব পুরস্কার।
আশির দশকে পরিবার নিয়ে রিসোর্টটিতে ছুটি কাটাতে আসা আনবার প্রদেশের এক শেখ বলেন, আমরা এটা বলতে অভ্যস্ত ছিলাম যে, এ রিসোর্টটি মূলত ইউরোপেরই একটি অংশ। আমি দেখেছি পুরুষ এবং নারীরা সুইমিং সুইট পরে হ্রদে সাঁতার কাটছে এবং নাচছে। এখানে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা ছিল না।
আট বছর ধরে হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণেও কমেনি হাব্বানিয়ার জৌলুস। উল্টো ১৯৮৯ সালে এ রিসোর্টকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছুটি কাটানোর গন্তব্য আখ্যা দিয়ে গোল্ডেন হোটেল ট্রফি পুরস্কারে ভূষিত করেছিল ফ্রান্সের একটি সংস্থা। ট্রফিটি এখনো সাজানো আছে ম্যানেজারের ডেস্কে। তবে, নেই সেই মুখরতা।
১৯৯০ সাল। সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করে বসলে কিছুটা ধাক্কা লাগে হাব্বানিয়ার সমৃদ্ধিতে। পরে জনসম্মুখে মদপান এবং বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা রিসোর্টের জন্য ছিল বড় ধাক্কা।
মদপান নিষিদ্ধ হওয়ার পরও রিসোর্টে বহু পরিবার ছুটি কাটাতে আসতো। বাগদাদের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী জাকি আল হাদ্দাদ স্মৃতিচারণ করে বলেন, হাব্বানিয়া সবসময়ই সুখস্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
২০০৩ সাল। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের ফলে পতন হয় সাদ্দাম হোসেনের। এরপর কিছু নিষেধাজ্ঞা সরে গেলে পুনরায় মানুষ হাব্বানিয়ামুখী হতে শুরু করে।
‘২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমরা প্রচুর পর্যটক পেয়েছিলাম। কিন্তু তারা শিক্ষায় এবং শ্রেণিগত দিক থেকে খুব একটা অভিজাত ছিলেন না। আমরা বিশেষত অভিজাত রাজনীতিবিদ এবং তারকাদের আপ্যায়ন করে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু ২০০৩ সালের পর যে কেউই রিসোর্টে আসতে পারতেন। যা আমার জন্য খুবই দুঃখজনক ছিল’, বলেন হামেদ সালামা।
২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানের পর এখানে পর্যটকদের আনাগোনা একেবারেই কমে যায়। ২০১৫ সালে এটি ‘শরণার্থী শিবিরে’ রূপ নেয়। আশ্রয় নেয় ২৪ হাজার বাস্তুচ্যুত ইরাকি। ২০১৭ সালে ইরাকের সরকার আইএসআইএলের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করার পর এখানে অবস্থান নেওয়া অধিকাংশই তাদের বাড়িতে ফিরে গেছে। তবে, এখনো অভিজাত এ হোটেলের পাশে তাঁবু গেড়ে বাস করছে হাজারখানেক মানুষ।
চলতি বছর মুয়াইদ মাশওয়াহ এ রিসোর্টের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পান। রিসোর্টটির পুরনো জৌলুস ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আশাবাদী তিনি। জিয়ারুল হক