অল্পের জন্য মন্দা থেকে বাঁচলো বিশ্ব অর্থনীতি
নূর মাজিদ : ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার মতো শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা থেকে আংশিক পরিত্রাণ পেয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। বাণিজ্যযুদ্ধ আর উত্তাল পুঁজিবাজার সাগরে দিক হারিয়ে অধিকাংশ প্রধান প্রধান শিল্প এবং আর্থিক ব্যবসাখাতের সূচকের তীব্র নিম্নগামিতা, বিশ্বকে দাঁড় করিয়েছিলো মন্দা ঘূর্ণাবর্তের কিনারে। সেই অবস্থা থেকে খানিকটা উত্তরণের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। গত জুন থেকে আগস্ট নাগাদ তিন মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিধি সার্বিকভাবেই দেড় শতাংশ কম হয়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের বিশ্বমন্দা পরবর্তী সময়ে এতো দুঃসময় আর দেখেনি বিশ্বের আমদানি-রপ্তানি। সর্বশেষ অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এক গবেষণা করে এমনটি জানিয়েছে নেদারল্যান্ডের ব্যুরো ফর ইকোনমিক পলিসি অ্যানালাইসিস। সংস্থাটির মূল নিয়ন্ত্রক ডাচ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়। ব্লুমবার্গ
গত ২৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হয় ওয়ার্ল্ড ট্রেড মনিটর শীর্ষক প্রতিবেদনটি। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই দুই মাসে শিল্প উৎপাদনের কিছুটা ইতিবাচক ধারা প্রত্যক্ষ করে। বিশ্বের শীর্ষ শিল্পোন্নত দেশগুলোয় সংকোচনের প্রবণতা এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। অধিকাংশ পিএমআই জরিপ এখন সেদিকেই নির্দেশ করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার কসপি১০০ বাজার বিশ্ব শিল্পপণ্য রপ্তানি বাণিজ্য বোঝার জন্য একটি সেরা সূচক। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি সিংহভাগ রপ্তানি নির্ভর হওয়ায় বাজারটিতে নিবন্ধিত কো¤পানিগুলোর দর বাড়া বা কমার স¤পর্ক, বিশ্ববাণিজ্যের অবস্থার সঙ্গেই ওঠা-নামা করে। আগস্ট মাসের নেতিবাচক অবস্থা কাটিয়ে বাজারটির সূচক গত বছরের তুলনায় এখন ১১ শতাংশর বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালের মে মাসের পর এটাই দক্ষিণ কোরীয় পুঁজিবাজারটির শীর্ষ অবস্থান। সুখবর আছে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের মুনাফা সূচকেও। ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে এখন প্রতি তিন মাস বাদে দেয়া নিয়মিত সুদের হার ২৩ বেসিস পয়েন্ট ওপরে। অথচ আগস্টে সুদহার ৫২ বেসিস পয়েন্ট কমানো হয়েছিলো। অর্থাৎ, আগস্টের মুনাফা রেখাচিত্রে (গ্রাফে) দেখা দেয় অন্তর্মুখী প্রবণতা। উল্লেখ্য, মন্দা পূর্ববর্তী সময়েই মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের প্রদত্ত সুদে এমন প্রবণতা দেখা যায়। কারণ, মন্দার সম্ভাবনা দেখলেই মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ স্বল্পমেয়াদি সুদহার কমায়। তবে সেপ্টেম্বরের শেষে এবং অক্টোবরের গোড়ার দিকে ট্রেজারিতে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরতে থাকে। তাদের ধারণা, এখন পর্যন্ত ফেড যেভাবে তিনধাপে সুদহার কমিয়েছে তা মার্কিন অর্থনীতিকে মন্দামুক্ত রাখাতে যথেষ্ট সমর্থন দেবে। এ ধারণাই পরবর্তীতে মার্কিন সরকারের বন্ড কেনায় বিনিয়োগ আরো বাড়াতে থাকে। বন্ড লেনদেনকারীরা প্রায় নিশ্চিত আগস্টে যে নেতিবাচক ধারা দেখা দিয়েছিলো তা একটি মধ্যবর্তী চক্রের গতি হারানো ছাড়া বড় কোনো বিপদের কারণ নয়। ১৯৬৭, ১৯৯৫, ১৯৯৮ আর ২০১৫ সালে এমন মধ্যবর্তী সুদহার কমার নজিরও ছিলো। একমাত্র ব্যতিক্রম হয় ২০০১ সালে, টুইন টাওয়ারে হামলা পরবর্তী সময়ে এবং ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দার প্রথমদিকে।
যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং জাপানের সাম্প্রতিক শিল্পপণ্য উৎপাদনের দিকে তাকালে পরিবর্তনটা আরো স্বচ্ছ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে আগস্টে মোটরকার ও এর যন্ত্রাংশ উৎপাদন বাদে সামগ্রিক উৎপাদন গতবছরের চাইতে দশমিক ৫ শতাংশ কমে। সেসময় জেনারেল মোটর কর্মীদের চলমান একটি বড় ধর্মঘটের প্রেক্ষিতে, মোটরকার শিল্পের উৎপাদন কমার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়নি। তবে টানা তিন মাসের গড় উৎপাদন বাড়ে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে। চলতি বছরে এই প্রথম দেশটির উৎপাদন খাতে এমন গতি লক্ষ্য করা যায়। একে দেখা হচ্ছে মন্দার হুমকি তৈরি করা শক্তিগুলোর দুর্বল হয়ে পড়ার সংকেত হিসেবে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর নাগাদ টানা তিন মাসে জাপানে শিল্পোৎপাদন দশমিক ৮ শতাংশ কমে। অক্টোবরে আবার উৎপাদন কমার গতিতে ভাটা পড়ে। জুলাই- সেপ্টেম্বরে ইউরোপের অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র জার্মানির শিল্পোৎপাদন ৪ শতাংশের উচ্চগতিতে নামতে থাকে। বড় ধরনের মন্দার আশংকায় ছিলেন অর্থনীতিবিদেরা। তবে জাপানের মতো অক্টোবরে উৎপাদন গতি কমার হার বাড়েনি।
সুদহার কর্তন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ অবসান সম্ভাবনা এবং সেবাখাতের সহনশীল অবস্থান বিশ্বের অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেয়। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি এবারের মতো মন্দার ঘূর্ণিপাক থেকে বেঁচে যায়। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান