আমাদের বিশ্ব • আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ৫
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সন্দেহ থাকলেও আতংকিত হওয়ার কারণ নেই
অনুবাদ-নূর মাজিদ : বাংলাদেশের অর্থনীতির চলতি প্রবণতা এবং সম্ভাবনা নিয়ে যারা খোঁজ-খবর রাখেন তারা সা¤প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দ্বিধা হতেই পারেন। তবে তা নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এই বিষয়ে আমি আস্থার সঙ্গেই অর্থনীতি পর্যবেক্ষকদের আশ্বস্ত করতে পারি। আসলে তারা, সামগ্রিক চিত্রে যে ভালো-মন্দ-অ¯পষ্ট সংবাদের মিশ্রণ রয়েছে, তার কারণেই সঠিক অনুমানে ব্যর্থ হচ্ছেন। এমন উদ্বেগ অবশ্যই যুক্তিপূর্ণ, তবে অনিশ্চতয়তার ভাবনা নিয়ে পড়ে থাকারও সুযোগ নেই। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ অচিরেই থামার কোন হুমকি দেখা যাচ্ছে না।
ভালো সংবাদ : ‘বাংলাদেশে ব্যবসায়িক আস্থা এখনো এশিয়া তথা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। বৈশ্বিক অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিকখাতও নিজেদের মানিয়ে চলার সক্ষমতা তৈরি করছে। নতুন নতুন বাজারে ঢুকছে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য। স্থানীয় বাজারেও নতুন অনেকখাত যুক্ত হচ্ছে; বিনিয়োগ, উদ্ভাবন এবং ক্রমশ দক্ষ হয়ে ওঠা একশ্রেণির শ্রমিকদের দক্ষতাবৃদ্ধির কারণে। এসব উন্নয়ন জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে অবদান রাখবে।’ সা¤প্রতিক সময়ে দেশের এক শীর্ষ সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন এইচএসবিসি ব্যাংকের বাংলাদেশ শাখার শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা।
হংকং-সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন বিশ্বের অন্যতম সেরা বাণিজ্যিক তথ্য বিশ্লেষক। তাই এইচএসবিসির শীর্ষ নির্বাহীর কাছ থেকে আসা এমন বক্তব্যের দিকে আমি উদ্বিগ্ন ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তিনি ব্যাংকিং জায়ান্টটির নেভিগেটর সার্ভে শীর্ষক এক জরিপের ভিত্তিতে এমন কথা বলেন। এই জরিপের মাধ্যমে ব্যবসায়িক আস্থা এবং স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক প্রত্যাশাকে নিরূপণ করা হয়। থাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পরিবেশ, ভূ-রাজনীতি, প্রযুক্তির বিকাশ ইত্যাদি বিষয় অনুসারে ব্যবসায়ীদের মতামতের প্রতিফলন। চলতি বছরের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর নাগাদ পরিচালিত এই জরিপে বাংলাদেশের মোট ১৯৩টি ক্ষুদ্র এবং বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা এখানে তাদের অভিমত দেন। প্রায় ৯৭ শতাংশ কো¤পানি পরিচালক আগামী বছর তাদের ব্যবসায়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি আশা করছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনায় ‘হাইগ্রোথ’ ক্যাটাগরির, যারা ১৫ শতাংশ বা তার বেশি প্রবৃদ্ধির আশা করছে। অথচ বৈশ্বিক গড়ে মাত্র ২২ শতাংশ হাইগ্রোথ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা উচ্চ মুনাফার আশা করছেন।
আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি বাণিজ্যকে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবেই দেখছে। ৯৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য আরো নতুন পণ্য ও সেবা উদ্ভাবনে সাহায্য করবে, এমন মতামতও দিয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদি ৯২ শতাংশ, নতুনখাতে ব্যবসায়িক দিগন্ত স¤প্রসারণে আশাবাদি ৮২ শতাংশ এবং এসবের কারণে কর্মসংস্থানের সংখ্যা বাড়ার কথা জানিয়েছে ৮১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান।
এইচএসবিসির জরিপ প্রতিবেদন আরো জানায়, বর্তমান বিশ্বে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের অন্যতম প্রধান কারণ বাণিজ্য সংরক্ষণবাদি নীতি। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু উন্নত রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি বাজারের দেশগুলো এই নীতির মাধ্যমে স্থানীয় পণ্য উৎপাদনকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, আমদানির তুলনায়। সুইডেন এবং জার্মানির কথা বাদ দিলে এই নিয়ে সবচেয়ে কম উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। দেশের রপ্তানিখাতের শীর্ষ নির্বাহীদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ (৪২%) সংরক্ষণবাদি বাণিজ্যিক নীতির প্রসার ঘটছে, এমন অভিমত দেন। তবে বিগত বছরে এর দ্বিগুণ বা ৯৩ শতাংশ ব্যবসায়ী নেতা এই বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানান। অর্থাৎ, আগের তুলনায় তারা এখন অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী।
অ¯পষ্ট তথ্যগুলোর দিকেও আলোকপাত করা দরকার : উপরে আলোচিত তথ্য বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মেলানো হলে তা খুব আশাজাগানিয়া ইঙ্গিত দেয়। তবে এখনও কিছু কিছু জায়গার শর্তসাপেক্ষে সংস্কার প্রয়োজন।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সুবাদে আয়বৃদ্ধির সুযোগ আরো কয়েক বছর পাবে। এরপর বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ায়, তা আর বাড়বে না। দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যার যথেষ্ট সরবরাহ থাকায় বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং নতুন বাজার বিকাশ স্বস্তা শ্রমমূল্যের প্রণোদনা পাচ্ছে। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের চলতি অর্থবছর তথা ২০১৯-২০ সালের এশিয়ান ইকোনমিক ইন্ট্রিগেশন শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরে। প্রতিবেদনে প্রকাশ, ১৮টি এশিয় অর্থনীতির ভেতর ৯টি যুবশক্তির সুযোগে ২০১৫ সাল থেকে আরো ২০ বছর অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, নেপাল এবং পূর্ব তিমুর। কর্মক্ষম জনশক্তির সরবরাহ কমার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। প্রথম কর্মক্ষম জনশক্তির সাহায্য অর্জিত আর্থিক উন্নতিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করতে হবে পরবর্তী বা দ্বিতীয় প্রজন্মের জনস¤পদ। মানব স¤পদের এহেন উন্নয়নে শ্রম দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের বিকাশে প্রকৃত বিনিয়োগ ও সরকারি বরাদ্দে মনোযোগী হতেই হবে। এই বিনিয়োগ নিশ্চিত করবে আজকের কর্মজীবীরা যখন দীর্ঘদিনের অবসরে যাবেন তখন তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং সন্তানদের উন্নয়ন। এটা তৈরি করবে তৃতীয় প্রজন্মের জনস¤পদভিত্তিক মুনাফার সুবিধা। অর্থনীতির ভাষায় একে বলা হয় সিলভার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট।
২০১৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বাংলাদেশের অবস্থান শেষের দিকে। এটা কারোরই কাম্য নয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর, সরকার প্রধানের শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ. রহমান বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা রপ্তানি বাজারে কতো ধরনের পণ্য রপ্তানি করা হয়, তার উপরেও নির্ভরশীল। গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশ আসলে কটন ট্রাউজার এবং শার্ট। অর্থাৎ, পণ্য বৈচিত্র্য খুবই কম। এ নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর উদ্যোগ এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের এগিয়ে না আসাও অন্যতম প্রধান কারণ। পরিস্থিতি উন্নয়নে রপ্তানি উৎসের নানামুখী সম্ভাবনা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাদ পড়বে বাংলাদেশ। এই উত্তরণের সাথে সাথে নতুন কিছু বিপদ দেখা দেবে রপ্তানির বাজারে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় রপ্তানি তখন শুল্ক বাধার মুখে কমে যেতে পারে। এমনকি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব আইনের আওতায় পড়বে দেশের রপ্তানি পণ্য। অর্থাৎ, প্রযুক্তি ও ডিজাইনে কপিরাইট মূল্য পরিশোধ করাটা হবে তখন বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প রপ্তানি এবং স্থানীয় বাজার এর ফলে মারাত্মক প্রভাবিত হতে পারে। মাত্র ১২টি মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশের সামনে তাই নানা উৎসে সংস্কারের কোন বিকল্প নেই। রেআ