সাক্ষাৎকারে ত্রিপুরার বিশিষ্ট সমাজকর্মী দুলাল রায় চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বললেন, আপনাদের কাছে আমরা চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবো
প্রিয়াংকা আচার্য্য : দুলাল রায় চৌধুরী ত্রিপুরার সমাজকর্মী। আগরতলা শহরে ছেলে নাতি-নাতনিসহ পরিবারের সঙ্গে নিজবাড়িতে থাকেন। অবসর জীবনে নিজের টুকটাক কাজ করাসহ বন্ধুদের নিয়ে প্রায় প্রতি বিকেলেই স্মৃতির পসরা সাজিয়ে আড্ডা চলে চায়ের সঙ্গে।
৮৮ বছর বয়সেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি ভীষণরকম জ¦লজ¦লে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ লাখ শরণার্থী ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিলো, যা রাজ্যটির জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে গেছিলো। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য ত্রিপুরার যে কজন ত্রাণ যোগাড়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন তিনি তাদের অন্যতম। গত ২৮ নভেম্বর সকালে তার বাড়িতে বসেই শোনা হলো সেইসব দিনের অভিজ্ঞতার কথা।
তখন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শচীন্দ্র লাল সিংহ। একদিন তিনি আমাদের ডেকে বললেন, তোমরা গণতন্ত্র প্রেমী ভারতীয় নাগরিক। পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রকে হত্যা করছে। তোমরা এবার প্রস্তুত হও। আমাদের প্রাক্তন মিলিটারি সদস্যরাও এখানে আসবেন। পূর্ব বাংলার গণতন্ত্রকামী যুবকরা যদি মুক্তিযুদ্ধের জন্য আত্মত্যাগে উদ্যোগী হয়, তবে তাদের সংগৃহীত করে ট্রেনিং দিয়ে উপযুক্ত করা হবে।
এখানে উল্লেখ করা উচিত, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের টার্গেটে পরিণত হয় ত্রিপুরা। এরা বিনা প্ররোচনায় ফায়ার ও শেল ফেলে নির্বিচারে দিনের পর দিন সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করতো। এসব দেখে আমাদের মধ্যে একটা প্রতিজ্ঞা জাগে যে, সরাসরি যুদ্ধে অংশে না নিলেও আমরা মুক্তি ফৌজদের সর্বাত্মক সহায়তা করবো।
সেভাবেই কাজ শুরু করা হলো। ত্রিপুরায় মোট ৮টি ট্রেনিং ক্যাম্প করা হয়েছিলো। রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুব্রমনিয়ামকে পুরো ত্রিপুরার দায়িত্ব সরকারিভাবে দেয়া হলো।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্যাম্পটি ছিলো বিশ্রামগঞ্জ ও চরিলামের মাঝে সেসরিমাইলে। আমার বন্ধু রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী ছিলেন এর দায়িত্বে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় আড়াই হাজার বাঙালি এখানে ট্রেনিং নিতে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, প্রফেসরসহ অনেক শিক্ষিত লোকেরা তখন যুদ্ধে অংশ নিতে এসেছিলেন। তাদেরকে বাংলাদেশের লোকেরা যেরকম কাপড় পরে সেরকম কাপড় দেয়া লাগবে। কারণ ট্রেনিং শেষে তারা দেশে ঢুকে সাধারণের সঙ্গে মিশলে যেন কেউ ভারতের বলে চিহ্নিত না করতে পারে। এছাড়া কাপড়সহ ওদের ব্যবহারের জন্য জিনিসপত্র লাগবে। এই সব সামগ্রী কিনতে আমাকে কলকাতায় পাঠানো হলো।
কলকাতায় গিয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু কেনার পর দেখলাম ৫ টন মালামাল হয়েছে। প্রায় ৫০ থেকে ৬০টা বড় বড় কাঠের বাক্স। তখন প্লেনে এতো মালামাল একসাথে আনার অনুমতি ছিলো না। আর সড়ক পথে আসাম হয়ে এই মাল আসতে গেলে তা দেড়-দুমাসের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের লাগবে ৭ দিনের মধ্যে।
ততোদিনে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়ে গেছে। আমার এক ভাইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের এক ডেপুটি সেক্রেটারি যিনি তখন মির্জাপুরে এক হোটেলে ছিলেন তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাদের পাঠালেন ১০ নম্বর থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের কার্যালয়ে। সেটা আগে ছিলো মেহতাজ খান্নার উদ্বাস্তু অফিস। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয় করার জন্য এটা ছেড়ে দেয়া হয়। একজন সেক্রেটারি আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের কাছে নিয়ে গেলেন। খুব সৌমদর্শন ব্যাক্তি, চেহারা খুব সুন্দর কিন্তু মাথায় চুল একটু কম। আমাদের সঙ্গে তিনি খুব ভালো ব্যবহার করলেন। বললেন, আপনি খুব ভালো কাজ করছেন। আপনাদের কাছে আমরা চির দিন কৃতজ্ঞ থাকবো। তবে আপনার সমস্যার সমাধান আমার কাছে নেই। তবে একজন আপনাদের সাহায্য করতে পারেন। তাকে ভারতের মানুষ খুব ভালোবাসেন। তার কথা এখানকার কেউ ফেলতে পারবেন না। তার কাছে আমি আপনাকে পাঠাতে পারি। তিনি হলেন হুসেন সাহেব।
হুসেন সাহেব হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম বাঙালি হিসেবে দেশের বাইরে কলকাতার পার্ক সার্কাসে অবস্থিত তখনকার পাকিস্তানি ভিসা অফিসে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে ভারতীয়রা তাকে অনেক সম্মান করতো। হুসেন সাহেবের অফিসে যেতে যেতে ৩টা বেজে গেলো। গিয়ে দেখি প্রচ- ভীড়। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষরিত চিঠি দেখালে অল্পক্ষণেই হুসেন সাহেবের দেখা পেলাম। তাকে আমাদের সমস্যার কথা বললাম। উনি তখন ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের জেনারেল ম্যানেজার মিস্টার মেহতার কাছে ফোনে রিকুয়েস্ট করলেন মুক্তি ফৌজের জন্য নিয়ে যাওয়া মালগুলো নিয়ে যেতে। মিস্টার মেহতা বললেন, এখনই পাঠিয়ে দিন। আমরা প্রায় বিকাল নাগাদ সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর ৭ তলায় এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে পৌঁছালাম। তিনি বিস্তারিত শুনে বললেন, এতো মাল আমরা কী করে নিবো। পরে একটা বিশেষ অর্ডার পাশ করে মাল নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। প্রত্যেকদিন ৫শ কেজি করে আর যদি সম্ভব হয় ১ হাজার কেজি করে মাল নিতে অর্ডার দিয়ে দিলেন কার্গো ম্যানেজারের কাছে। পরে ম্যানেজার আমাদের জিনিসগুলো বুঝে নিলেন। আর এরপর দিন থেকেই মুক্তি ফৌজের এসব জিনিস আগরতলায় আসতে শুরু করে।
এরপর ফিরে আমার স্ত্রী ও সদ্যভূমিষ্ঠ ছেলেকে নিরাপত্তার জন্য উদয়পুর বাড়িতে রেখে ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জীর সঙ্গে থেকে কাজ শুরু করি। তার অ্যাসিস্টেন্টের মতো। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা কী খাবে, তাদের কী কী দরকার সেসব তদারকি করি। রাতে মিলিটারির লোকেরা আমাদের নানারকম ট্রেনিং দিতো। লেফটেনেন্ট জেনারেল মি. করের ক্যাম্প ছিলো খাসিয়া মঙ্গলে। তিনি সেখান থেকে এসে আমাদের নিরাপদে থাকার জন্য ট্রেঞ্চ বানানো শেখান।
ভারত সরকার তখন আগরতলায় ৪টা যুদ্ধ বিমান মজুদ রেখেছিলো। এগুলো মাঝে মাঝে অ্যাকশন করতে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকলে আমরা সাধারণ মানুষেরা খুব শংকিত থাকতাম ফিরে আসবে কিনা তা নিয়ে। যখন দেখতাম ৪টা প্লেনই গিয়ে ফিরে এসেছে আমরা হাততালিসহ আনন্দ ধ্বনি দিয়ে নিজেরা উল্লাস করতাম। আমরা প্রায় প্রতিদিনই এটা অবজার্ভ করতাম। কটা বিমান গেলো আর ফিরলো কটা।
ত্রিপুরায় আমরা সবাই তখন বেশ ঔতসুক হয়ে কাজ করেছি। ভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমরা সবাই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ফুল, ফল, জলের বোতল ও শুকনো খাবার দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছি। এছাড়া স্থানীয়রা সেনাবাহিনীর লোকেদের পথঘাট চিনিয়ে দিতে অনেক সাহায্য করেছে। একদিন এক মিলিটারি অফিসার বললেন, রাতের বেলা মার্চ করবে। সামনে থাকা সৈন্যরা রাস্তা চিনলেও পেছনে যারা থাকবে তারা কীভাবে পথ চিনবে। তখন মিস্টার কর আমাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। আমরা বুদ্ধি বের করলাম, সাদা ফিতার মধ্যে সালফার মিশিয়ে ট্র্যাক বানাবো। একদিনের ভেতর আমরা অনেক ফিতে ও ফসফরাস সংগ্রহ করে ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ট্র্যাক তৈরি করলাম। মিলিটারি অফিসারদের এটা খুব কাজে লেগেছিলো। এতে টাকা খরচ হলেও তারা এই বুদ্ধির জন্য আমাদের অনেক প্রশংসা করেছিলো।