প্রথম পাতা • মিনি কলাম • লিড ২
দৈনিক সংবাদ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার
প্রিয়াংকা আচার্য্য : গৌতম কর ভৌমিক ত্রিপুরার প্রবীণ সাংবাদিক। আগরতলার শহরতলীতে স্ত্রী ও ছেলে নিয়ে নিজবাড়িতে থাকেন। ছেলেও সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তার বাবা ছিলেন আগরতলার জেল সুপার। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি। ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলায় গেলে একটি রাত তাদের বাড়িতে থেকেছিলেন। ‘একাত্তরে আমি ছিলাম ১৯ বছরের তরুণ। লেখাপড়ার ফাঁকে ত্রিপুরার বিখ্যাত পত্রিকা দৈনিক সংবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। পাশাপাশি সিভিল ডিফেন্সে কাজ করতাম। যুদ্ধ চলাকালে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ট্রেঞ্চ বানাতাম। বিশেষ ট্রেনিংও নিয়েছিলাম।’
‘দৈনিক সংবাদ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার। বাংলাদেশের পক্ষে এই পত্রিকা এতোটাই কাজ করেছিলো যে পাকিস্তানিরা আগরতলায় যে কয়েকটি জায়গায় টার্গেট শেলিং করেছে তার মধ্যে অন্যতম ছিলো দৈনিক সংবাদ অফিস। কিন্তু তাদের টার্গেট মিস হওয়ায় শেলটি অফিস থেকে একশ গজ দূরে বিধুর চৌমুহুনীতে পরে। এছাড়াও বনমালীপুর, অরিয়ন চৌমুহুনীসহ বেশ কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে শেলিংয়ে কয়েকজন সিভিলিয়ান মারা যান।’
‘সেসময় শহরজুড়ে ব্ল্যাক আউট হতো। সেই ব্ল্যাক আউট মেইনটেইন করতে আমরা রাতের পর রাত ডিউটি করেছি। ভুলে হয়তো কেউ সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছেন। আমরা সেটি নিভিয়ে দিয়ে বলতাম- দাদা সিগারেট খাবেন না। আপনার এই সিগারেটই হয়তো শহর ধ্বংসের কারণ হবে। দেশলাইটা দিন। কত গাড়ির হেডলাইটে যে আলকাতরা মাখিয়েছি তার কোনও হিসাব নেই। শহরের প্রত্যেকটা সিটি লাইটে আমরা কালো টোপর পরিয়ে দিয়েছিলাম। ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতাম যেন সেখান থেকে বিন্দুমাত্র আলো উপরের দিকে না যায়। আমাদের ট্রেনিংয়ে বলা হয়েছিলো, সিগারেটের আলো থেকেই বিমান থেকে শেলিং করতে সিগারেটের আলোই যথেষ্ট।’
‘ডিসেম্বরের শুরুতে আমাদের কাছে খবর এলো পাকিস্তানি সেনারা ত্রিপুরায় আক্রমণ করবে। প্রচুর শেলিং করবে। আগরতলা শহর গুড়িয়ে দেবে। কিন্তু তার আগেই পরিস্থিতি বুঝে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘোষণা আসে। আর ভারতের সেনাবাহিনী আখাউড়া সীমান্তে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের পরাস্ত করে।’
‘সেই রাতের স্মৃতি আগরতলাবাসী কখনও ভুলবে না। বাবা মা দাদা ও আমি ট্রেঞ্চে কাটিয়েছি। সারারাত্রি প্রচ- গোলাগুলি। আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে গেছিলো বিকট সব শব্দে। দিনভর উৎকণ্ঠায় আমরা ঘর থেকে বের হতে পারিনি।’
‘পরদিন খুব ভোরবেলা বাড়িতে ফোন এলোÑমুভ টু সিভিল ডিফেন্স কোয়ার্টার। যাওয়ার পর নিরবিচ্ছিন্নভাবে আমরা কাজ শুরু করলাম। আমার পোস্টিং দেয়া হলো মঠ চৌমুহুনীতে। সেই পথ দিয়ে আর্মি তখন ঢুকছে। কিন্তু তারা তো লোকাল পথ ঘাট চেনে না। ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা আমরাই তখন তাদের রাস্তা বলে দিতাম কী করে করে ক্যাম্পে পৌঁছাবে।’
‘হঠাৎ সিভিল ডিফেন্স থেকে রিকুইজিশন দেয়া হলো এয়ারপোর্টে মুভ করতে। আমি সিভিল ডিফেন্সে ফার্স্ট এইড উইংয়ে কাজ করতাম। এয়ারপোর্টে আমাদের বলা হলো- ক্যাজুয়ালিটি আসবে। ভয়ংকর ক্যাজুয়ালিটি আসবে। আমাদের কাজ আহত সেনাদেরকে প্রাথমিক ফার্স্ট এইড দেয়া। এরপর গাড়ি রেডি থাকবে জখমের গুরুত্ব বুঝে পরবর্তী চিকিৎসা হাসপাতালে দেয়া হবে।’
‘সারাদিন কাজ করে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তা এ জীবনে ভোলা সম্ভব না। সৈন্যদের কারও হাত নেই। কারও পা নেই। কারও পেট অর্ধেক কাটা। ভারতীয় সেনারা আখউড়া সীমান্ত দিয়ে ধান ক্ষেত পার হয়ে ঢুকেছিলো। পাকিস্তানিরা সীমান্ত ঘেষা সেইসব ধান ক্ষেতে অ্যান্টি পার্সনোল মাইন পেতে রেখেছিলো। ফলে ভারতীয় সেনারা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নিদারুণভাবে হতাহতের শিকার হয়।’
‘পরদিন অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের এয়ারপোর্টে নিয়ে আসা হয়। আমরা ফার্স্ট এইড দিলে সেখান থেকে তাদের আর্মি হাসপাতাল, জিবি হাসপাতালে নেয়া হয়। মোটা মোটা তুলার বান্ডিল তাদের গায়ে পেচিয়ে দিতাম। সমস্ত শরীর জুড়ে রক্ত আর রক্ত। আমি রক্তের গন্ধে দুদিন ভাত খেতে পারিনি।’ সম্পাদনা : মোহাম্মদ রকিব