সাক্ষাৎকারে একাত্তরে আগারতলায় হতাহতের পরিবার শেল পরার পর বাবা চিৎকার করে মাকে বললেন, ওদের দেখো
প্রিয়াংকা আচার্য্য : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ত্রিপুরার সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামে প্রায়ই বোমা ফেলতো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। যুদ্ধের শেষ দিকে তারা আগরতলা শহরেও কয়েকবার বিমান থেকে বোমা ফেলেছে। এতে হতাহত হয়েছেন অনেকেই। নিহতদের একজন ছিলেন সন্তোষ মুখার্জী। আগরতলা মহাকরণে (সচিবালয়ে) কাজ করতেন। থাকতেন শহরের বনমালীপুর। তার স্ত্রী এখনও আছেন বয়স ৮২। মেয়ের সঙ্গে অধিকাংশ সময়েই অসুস্থতার কারণে কলকাতায় থাকেন। সেই দিনটে নিয়ে কথা হলো তার ছেলে কল্যাণ মুখার্জী ও প্রতিবেশির সঙ্গে।
কল্যাণ মুখার্জী বললেন, দিনটা ছিল ২৪ অক্টোবর ১৯৭১। আমার মা ইলা মুখার্জীর বয়স তখন ৩৩। আর আমি ক্লাস ফাইভে, ভাই থ্রি ও বোন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সন্ধ্যা তখন সাড়ে ৭টা। আমরা খাওয়া-দাওয়ার পর মুখ ধুচ্ছিলাম। এমন সময় উপর দিয়ে আগুনের গোলার মতো কিছু ছুটে যেতে দেখলাম। বাবাই আমাদের বললেন, মনে হয় শেলিং হচ্ছে, চলো আমরা শেল্টার নিয়ে নিই। হঠাৎ বিকট এক আওয়াজ। ঝড়ের মতো যেন কি একটা হয়ে গেল। ধুলাবালির ঝড়। বাবা চিৎকার করে বললেন, নারায়ণ, নারায়ণ! সর্বনাশ হয়ে গেছে। মা তাড়াতাড়ি কাছে যেতেই বললেন, ওদের দেখো। এরপর আর কোনও সাড়া নেই। চারপাশ রক্তে ভরে গেছে। আশপাশের পাড়া প্রতিবেশিরা সবাই ছুটে এলেন। আমাদের বাড়ির পাশে তখনকার মন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্ত থাকতেন। তিনি এসে অনেককে ফোন করলেন। বাবাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি চলে গেছেন।
প্রতিবেশি ডা. ভোলানাথ সাহা জানালেন, সেদিন আগরতলা শহরে ব্ল্যাক আউট চলছিল। সন্তোষ মুখার্জীরা থাকতেন আমাদের পেছনের বাড়িটায়। শেলটা পরার পর আমি ও আমার বোন চিৎকার শুনে তাদের বাড়ি গিয়ে দেখি রক্ত আর রক্ত। আশপাশের অনেকেই তখন ছুটে এসেছিলেন। রক্ত-টক্ত পরিস্কার করার হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।
ভুবন চন্দ্র সাহা একাত্তরে ছিলেন বিশ-বাইশ বছরের টগবগে তরুণ। বাবা সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা, মা নীরোদা সাহা। থাকতেন বনমালীপুরে ভাড়া বাসায়। শেল কেড়ে নিয়েছিল তার মায়ের পা। শুনলাম সেই কথাও। সন্ধ্যা তখন আটটা। বাবা মায়ের সঙ্গে বারান্দায় বসে বোন ও আমি গল্প করছি। এমন সময় শেলটা পরলো আমাদের বাসার ভেতরে সাপ্লাইয়ের কাছে পাকা জায়গাটায়। আমরা দেখলাম মায়ের একটা পা হাটুর নিচ থেকে উড়ে পনেরো হাত দূরে পরলো। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গেলো। আমরা অনেক কষ্টে আলো যোগার করে মাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে রাস্তায় গেলাম। পথে অ্যাম্বুলেন্স পেয়ে তাকে জিবিতে ভর্তি করা হলো। এরপর নানা অপরেশন হলো। ৩ মাস তিনি জিবিতে ভর্তি ছিলেন।