বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি দর্শন ‘নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার’ অনেকটাই উপেক্ষিত
মোল্লাহ আমজাদ হোসেন : ১৯৭২ সালে দেশে ফেরার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশলও চূড়ান্ত করতে শুরু করেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধান চালিকা জ্বালানি খাতের উন্নয়নে নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করা। তখন দেশে প্রচলিত আইন অনুসারে রয়্যাটির আওতায় তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সম্ভাবনাময় অঞ্চল লিজ দেয়া হতো। তেল বা গ্যাস আবিষ্কার হলে তার মালিকানা পেত কর্মরত কোম্পানি। বঙ্গবন্ধু সকল সম্পদের মালিকানা জনগণের হাতে আনার জন্য কাজ শুরু করলেও তাড়াহুড়োর পথ বেছে নেননি। প্রথমে শুরু করেছেন প্রতিষ্ঠান ও জনবল তৈরির কাজ।
পাকিস্তানে আমলে সরকারের সাথে লিজিং চুক্তির আওতায় শেল ওয়েল ও পিপিএল (পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড) এই অঞ্চলে কর্মরত ছিল। (প্রথম পৃষ্ঠার পর) পিপিএল সিলেট ও ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে সীমিতভাবে উৎপাদনও শুরু করে।
তেল গ্যাস অনুন্ধানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল শেল ওয়েলের। তারা ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছিল। তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, হবিগঞ্জ ও কৈলাসটিলা। তিতাস ও হবিগঞ্জ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে সীমিতভাবে উৎপাদন করে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো। ঐ গ্যাস ক্ষেত্র ও বিতরণ কোম্পানির শতভাগ মালিকানা ছিল শেল ওয়েলের।
বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনামাফিক শেলকে আবিষ্কার করা গ্যাস ক্ষেত্রগুলো উন্নয়ন ও গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর অনুরোধ জানায় পেট্রোবাংলা। কিন্তু শুরুতে তারা গুরুত্ব দেয়নি। ১৯৭৪ সালে প্রণীত পেট্রোলিয়াম অ্যাক্টের কিছু ধারা প্রয়োগ করে শেলের আবিষ্কার করা রশিদপুর গ্যাস ক্ষেত্র অধিগ্রহণ করে পেট্রোবাংলা। এতে নড়চড়ে বসে শেল ওয়েল বাংলাদেশ কর্তারা। পেট্রোবাংলা তাদের ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র ও বিতরণ কোম্পানি সরকারের কাছে বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব দিলে আলোচনা শুরু হয়।
অবশেষে সাড়ে ৪ মিলিয়ন পাউন্ডে শেল তার সম্পদ বিক্রিতে সম্মত হয় এবং বাংলাদেশ তা ৯ কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ পায়। এটা নিয়ে চূড়ান্ত চুক্তি হয় ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট। যা বর্তমানে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর দায়িত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দিবসটিকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসাবে পালন করতে শুরু করে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের পক্ষ থেকে ৯ আগস্টকে জ্বালানি নিরাপত্তা হিসাবে পালনের জন্য একটি রাউন্ড টেবিল আয়োজন করে।
অবশ্য শেল এর সম্পদ কিনে নেয়ার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু খুব কৌশলী ও সর্তক ছিলেন। যাতে এটাকে কেন্দ্র করে সদ্য স্বাধীন দেশের সাথে বন্ধু রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডের সম্পর্কে কোনো ধরনের টানপোড়ন সৃষ্টি না হয়। এ কারণেই কোম্পানি ও গ্যাস ক্ষেত্র বিক্রির পরও তা পরিচালনায় দীর্ঘসময় ধরে সহায়তা অব্যাহত রেখেছিল শেল ওয়েল। এই ৫টি গ্যাস ক্ষেত্র কিনে নেয়ার কারণেই দীর্ঘ প্রায় ৫ দশক দেশে সাশ্রয়ী গ্যাস পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। ঐ ক্ষেত্র ৫টি থেকে এখনো দেশের মোট চাহিদার ৩০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে।
শুধু তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর কাজ সীমিত থাকেনি। ১৯৬২ সালে ইউএন পাক মিনারাল সার্ভে তাদের অনুসন্ধান এবং স্টানভ্যাকের তেল অনুসন্ধানের তথ্য বিশ্লেষণ করে আবিষ্কার হয় জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র। স্বাধীনতার আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়ন না করায় পাক শাসকদের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও তিনি জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়ন না করা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। স্বাধীন দেশে তিনি এই কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। তখন জামালগঞ্জ নিয়ে সমীক্ষার জন্য বিএমইডিসির পক্ষ থেকে একটি জার্মান খনি কোম্পানি ফ্রেড ক্রাফ রোসটেফ কে নিয়োগ করা হয়। সমীক্ষা পর্যলোচনা করে দেখে মতামত দেয়ার জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি পাওয়েল ডুফ্রনকে নিয়োগ করা হয়। পাওয়েল তার সুপারিশে মতামত দেয় যে, কয়লা স্তরে যাওয়ার আগে লাইম স্টোনের একটি স্তর আছে। তখন বিএমইডিসি কয়লার বদলে লাইম স্টোন আহরণে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এখন পর্যন্ত দুটির কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। অবশ্য বঙ্গবন্ধু বড়পুকুরিয়াসহ রংপুর এবং দিনাজপুর জেলার অপরাপর কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়ন করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নিলেও তা তাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার পর থমকে যায়। তবে কঠিন শিলা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করেন তার হত্যাকান্ডের আগেই।
কেবল প্রাথমিক জ্বালানি খাত নয় সেকেন্ডারি জ্বালানি বিদ্যুৎখাত উন্নয়েন বঙ্গবন্ধু অগ্রাধিকার ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি বিশ্বাস করতেন সকল নাগরিকের বিদ্যুৎ পাওয়া অধিকার। তাই বিদ্যুৎখাতের সম্প্রসারণ করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সকল মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন তিনিই প্রথম দেখেছিলেন। বলে রাখা দরকার তাঁর জন্ম শতবর্ষে তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০২০ শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসতে যাচ্ছে।
জ্বালানি খাত নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও পরিকল্পনা এখানেই থেমে থাকেনি। তিনি তেল আমদানী নিবিঘœ করার জন্য ডিপ সি জেটি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখেছিলেন তখন। রান্নার জ্বালানি উন্নয়নে তেল শোধনাগারে প্রপেন-বিউটেন পুড়িয়ে না দিয়ে তা সংগ্রহ করে এলপিজি বোতলজাত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বলেছিলেন।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু কোনো বিচ্ছিন্ন চিন্তা থেকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাত উন্নয়ন এবং নিজস্ব সম্পদ ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেয়ার কাজ শুরু করেননি। তার পুরোটাই ছিল তাঁর ভিশনারি পরিকল্পনার অংশ। ১৯৭৩ সালে নেয়া বাংলাদেশে প্রথম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার দিকে নজর দিলে তা আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। এতে কয়লা অনুসন্ধান আরও জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির ক্ষমতা বাড়ানো এবং সেখানে এলপিজি উৎপাদনের প্লান্ট স্থাপনের নির্দেশনাও ঐ পরিকল্পনাতেই ছিল। তেল আমদানী সহজ করতে ডিপ সি টার্মিনাল করার নির্দেশনা ছিল যা এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে ১৯৭৮ সালে পেট্রোবাংলাকে তেল আমদানী ও বিপণন দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন গঠন করা হয়। বিপিসিই প্রথম দেশে বোতলজাত এলপিজি সরবরাহ করতে শুরু করে। বর্তমানে এলপিজি খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশে তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ ছাড়া শিল্পায়ন নিশ্চিত করা এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়। কেননা তিনি শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য ও সাধারণ ব্যবহারের জন্য অ্যাফোর্ডেবল দামে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।
কিন্তু জ্বালানি পরিকল্পনায় বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তথা প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে। গত ১৫ বছর নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ব্যবহারে বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে। এই সময়কালে ১০ টিসিএফ এর মতো গ্যাস ব্যবহার করা হলেও নতুন আবিষ্কার ২ টিসিএফ এর বেশি নয়। উন্নতমানের কয়লার মজুদ থাকার পরও তা ব্যবহার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার। ২০৪১ সাল পর্যন্ত ৬০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা জ্বালানি হিসাবে কয়লা ও এলএনজি-গ্যাসের অবদান ধরা হয়েছে ৩৫ শতাংশ করে। কয়লার ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ দেশীয় কয়লা ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে, বাকিটা আসবে আমদানী হয়ে। বর্তমানে ১০০০ এমএমসিএফডি এলএনজিসহ গ্যাসের সরবরাহ ক্ষমতা ৩,৭০০ এমএমসিএফডি। ২০৪১ সালে নিজস্ব সরবরাহ শূন্যে নেমে আসবে তার চাহিদা পূরণ হবে এলএনজি আমদানীর মাধ্যমে।
ভারত ও মায়নমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও বাংলাদেশ এখনো সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে সক্ষম হয়নি। আর পরিবর্তিত বিশ্বপ্রেক্ষাপটে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগ আকর্ষণ আপতত বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলে আমদানী নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। যা নতুন শিল্পায়নের জন্য কতটা সহায়ক হবে তা বলা খুব মুশকিল।
যদিও পরিকল্পনা আছে ২০৪১ সালের মধ্যে তেল নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার। করোনা মহামারীর কারণে এই সময়কালে গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে এবং কমেছে তেলের ব্যবহার। তাতে অবশ্য বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় কমবে।
এখনকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিকল্পনা বিচার করে সহজেই বলা যায়, নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারে বঙ্গবন্ধুর যে অগ্রাধিকার তা থেকে তার দল কিছুটা সরে এসেছে। পরিকল্পনা অনুসারে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে জ্বালানি আমদানী নির্ভর দেশগুলোর কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কেন এমনটি হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি বলেন, আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন দিকনির্দেশনা থেকে সরে এসেছি বা যাচ্ছি তা সঠিক নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। এ বছরই শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হবে। এটি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সঠিক বাস্তবায়ন। তবে বিশ্ব বাস্তবতা ও অর্থনীতিকে গুরুত্ব্ দিয়ে আমরা কয়লা ও এলএনজি আমদানী শুরু করেছি। আমাদের গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। কয়লা তোলার বিষয়ে সমীক্ষা চলমান আছে এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এম তামিম দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন বাংলাদেশ যে জ্বালানি ব্যবহার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে তাকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি মিলিয়ে ৯০ শতাংশ আমদানী নির্ভর হয়ে যাবে। তখন শিল্পের জন্য সহনীয় জ্বালানি মূল্য বজায় রাখার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। বুয়েটের অধ্যাপক প্রফেসর ড. ইজাজ হোসেন মনে করেন, জ্বালানিঘণ প্রসেস শিল্প আমদানী করা গ্যাসের দাম মিলিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষম থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। ফলে কম জ্বালানি দরকার এমন শিল্পকে উৎসাহিত করতে হবে।