দেশে ৩ বিলিয়ন টন কয়লা মজুদ কাটছে না আমদানি নির্ভরতা
শাহীন চৌধুরী : দেশে ৭৬ টিসিএফ গ্যাসের সমপরিমাণ ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন টন উন্নতমানের কয়লা মজুদ রয়েছে। কিন্তু এই কয়লা আহরণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সরকার এখনও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছে দেশ। অপরদিকে ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে মজুত গ্যাস নিঃশেষ হয়ে যাবে ফলে মারাত্মক জ্বালানি সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জ্বালানিখাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশকে এই অবস্থা থেকে রক্ষায় কয়লা উত্তোলনের কোনও বিকল্প নেই। সম্প্রতি এক অনলাইন আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা এই মতামত প্রদান করেন। বিদ্যুৎ জ্বালানিখাতের সাংবাদিকদের সংগঠন এফইআরবি ও বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন-বিপ্পার যৌথ উদ্যোগে ওই আলোচনার আয়োজন করা হয়। বক্তাদের আলোচনায় জ্বালানি সেক্টরের অর্জনসহ নানা সমস্যা উঠে আসে। এতে দেশের অনাহরিত কয়লাসম্পদ, ঝুলে থাকা ফুলবাড়ি কয়লাপ্রকল্প, খাতটিতে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়।
এতে বলা হয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ে তুলতে নিজস্ব সম্পদের সর্Ÿোচ্চ ব্যবহার করে শিল্পায়নসহ যাতে সাধারণ মানুষকে সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ জ্বালানি সহজে পায় তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ দর্শন থেকেই তিনি তেলগ্যাস আহরণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। এর মধ্যদিয়েই ১৯৭৩ সালে অনশোর বিডিংয়ের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানি খনিজসম্পদ আহরণ শুরু করে। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে তেলসঙ্কটের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাসফিল্ডগুলো কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আইন সংশোধন করেন। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে ৫টি গ্যাসফিল্ড সাড়ে চার মিলিয়ন পাউন্ডে কিনে নেন। বর্তমান সরকারের পাওয়ার সিস্টেম মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, গ্যাস ও এলএনজি থেকে ৩৫ ভাগ, কয়লা দিয়ে ৩৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এর মধ্যে ৩৪ ভাগই আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভর করা হয়েছে। যদিও বিভিন্ন এনালাইসিসে বলা হচ্ছে, আমরা যদি আমদানির বদলে নিজস্ব কয়লা ব্যবহার করে খনিমুখে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে পারি, তাহলে উৎপাদন খরচ ৩০ ভাগ কমে যাবে। অথচ বঙ্গবন্ধুর অপশন ছিল নিজস্ব জ্বালানি সম্পদকে ব্যবহার করে জ্বালানি চাহিদা মেটানো এবং সস্তায় জ্বালানি সরবরাহ করা। অলোচনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি বহুমুখীকরণে আমরা সব পথ খোলা রেখেছি। যাতে একটিতে সমস্যা হলে অন্যটিতে যাওয়া যায়। সমালোচনা হবেই তবে আমি কাজ করে যাওয়ায় বিশ্বাসী। ২০১০ সালের বিদ্যুৎ সেক্টর মহাপরিকল্পনা ২০১৫ সালে এসে রিভিউ করেছি। বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন আনতেই হয়। আমরা তো সবকিছু আমাদের দেশে উৎপন্ন করি না। কয়লা আছে তুলবো কি, তুলবো নাÑ এতে রাজনীতি জড়িত। আমাদের দেখতে হবে পরিবেশের কি ক্ষতি হবে, কৃষকের জমি বাঁচিয়ে তাকে ব্যবস্থা করে দিয়ে কিভাবে আমরা করবো সেটাই অগ্রাধিকার।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার কাছে অগ্রাধিকার হচ্ছে দেশের মানুষ, জলবায়ূ, পরিবেশ। তিনি বলে দিয়েছেন, এই দুটিকে স্পর্শ না করে, ক্ষতি না করে যদি কিছু করতে পারো করো। তাই সেই প্রযুক্তির দিকেই আমরা যাচ্ছি। এরকম না যে, আমরা করবো না। কয়লা আমাদের জন্য লাভজনক হবে কিনা, নাকি বাইরে থেকে আমদানি করে নিয়ে আসাই আমাদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করবেÑএ বিষয়গুলো আমাদের সামনে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট যখন বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে ৫টি গ্যাসফিল্ড কিনে নেয়ার দিন তিনি বলেছিলেন, আজ আমি বাংলার মুক্তি সনদে দস্তখত করবো। বিদ্যুৎ জ্বালানি এমন একটা জিনিস, যা রাতারাতি ঠিক করা যায় না। গ্যাস বিদ্যুৎ জ্বালানি আন্তর্জাতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয়। আজকের আলোচনা থেকে বুঝেছি, এখাতে আমাদের অর্জন অনেক। তবে চ্যালেঞ্জও অনেক আছে। বাপেক্স এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুর্ত্তজা আহমেদ ফারুক বলেন, সরকার আমদানি করা কয়লায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে, সেটার প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি নিজস্ব কয়লাসম্পদ আমাদের রয়েছে যা জামালগঞ্জসহ হয়তো ৫ বিলিয়ন টনের মতো হতে পারে। সব মিলিয়ে আমাদের যে কয়লা সম্পদ আছে, সেটা উত্তোলন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দেশের সম্পদ আহরণ ও দেশকে জ্বালানিতে স্বনির্ভর করে তোলা। কয়লা উত্তোলন করা হলে সাশ্রয়ী মূল্যে আমরা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো।
পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার সালেক সুফি বলেন, সরকার যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো করছে আমদানির ওপর নির্ভর করে, সেখানে পায়রা ও রামপালে কয়লা পরিবহনের সমস্যা রয়ে যাবে। একমাত্র বিকল্প মাতারবাড়ি। মাতাবাড়িতে এখন যে কয়লাবন্দর হচ্ছে সেটা হয়তো ওখানকার দুটি প্লান্টের জন্য। মাতারবাড়িতে কয়লাবন্দর করতে পারেন কিনা সরকারকে সেটা ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। ‘বঙ্গবন্ধু, জ্বালানি নিরাপত্তা ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই অলোচনায় মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার পত্রিকার সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন। আরও আলোচনায় অংশ নেন, পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালিদ মাহমুদ। এফইআরবি চেয়ারম্যান অরুণ কর্মকার, সিনিয়র সাংবাদিক শাহনাজ বেগম, এনার্জিবাংলা পত্রিকার সম্পাদক রফিকুল বাশার প্রমুখ। রেজা