অস্তিত্ব সংকটে দেশের নারী উদ্যোক্তারা
জেরিন আহমেদ : বাংলাদেশে কোভিডের প্রভাবে গত প্রায় চার মাস ধরে কার্যত নতুন পুরনো সব উদ্যোক্তারাই ঝুঁকির মুখে পড়েছেন, তবে এর মধ্যে যারা একেবারেই নতুন করে শুরু করেছিলেন তাদের কার্যত পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এদের মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যাই বেশি। এর ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান নেমে যাচ্ছে, তারা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
ব্র্যাক ইনিস্টিটিউট অব গভার্নেন্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য মতে কোভিডের আঘাতে দেশের ২৪ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। গবেষণায় অংশ নেয়া ২০০ নারী উদ্যোক্তাদের ৯০ শতাংশ কোভিডের আঘাত কাটিয়ে উঠতে ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে কোনো ঋণ সহায়তা পাননি বলেও জানিয়েছেন। ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা আগে থেকেই ব্যাংকিং লেনদেনে থাকলেও সংকটের সময়ও তাদের বেশি ভাগই ব্যক্তিগত খাত বা পারিবারিক উৎস থেকেই ঋণ করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, নারী উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশরই কোনো ব্যবসা নিবন্ধন বা ট্রেড লাইসেন্স নেই। ফলে তাদের সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ঋণের সুবিধার আওতায় আসার সুযোগ নেই। এ ছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট (স্টেপস) এবং জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্সের (গ্যাড অ্যালায়েন্স) তথ্য অনুযায়ী, লকডাউনের সময় থেকে ৮০ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের চলমান ব্যবসা বা উদ্যোগ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন।
‘গহনা হাটবাজার’ নামে একটি এফ-কমার্স প্ল্যাটফর্মে নারীদের বিভিন্ন ধরনের গহনা আইটেম বিক্রি করেন ফাতেহা আক্তার। নিজস্ব কারিগর দিয়ে নিজস্ব ডিজাইনে গহনা প্রস্তুত করেন ফাতেহা। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় দুই লাখ টাকার গহনা বিক্রি করে গহনা হাটবাজার। তিনি বলেন, সব পণ্য মজুদ হয়ে পড়ে আছে। কোভিডের কারণে বিক্রি আর ডেলিভারি একেবারেই বন্ধ। সেল বন্ধ হলেও কর্মীদের বেতন তো চালিয়েই যেতে হবে। আমি ছোট ব্যবসায়ী আমার মূলধন অনেক বেশি না। সব শুরু হলেও গহনা কেনার মতো অবস্থা কতোদিনে মানুষের হবে সেটা নিয়েও সন্দিহান।
অনলাইন ভিত্তিক খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আজান কিচেনের প্রতিষ্ঠাতা খুরশিদা বলেন, আমরা নারীরা যারা নিজেদের ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল তারা আজ সবকিছু বন্ধ করে বসে আছি। সেটা ছাড়া এই সময় কারও কাছে কোনো উপায় নেই। কিন্তু যে ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হচ্ছি সেটা সামলে ওঠা খুব কঠিন হয়ে যাবে।
অনলাইন ভিত্তিক পোষাক বিক্রয়কারী শাহেদা’স ফ্যাশনের কর্নধার সারজানা বলেন, প্রত্যেক নারী উদ্যোক্তা এক একটা শিল্প নিয়ে কাজ করে। তার সঙ্গে যেমন তাদের নিজেদের জীবনযাত্রা নির্ভর করে, তেমনি সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে অসংখ্য মানুষ। সেই আয়ের ওপর তাদের পরিবার নির্ভরশীল। এসব কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের আয়ের উৎসও আজ বন্ধ। আজ যে অবস্থায় নেমে এসেছে আমাদের ব্যবসা, কোনো অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়া আমরা টিকে থাকতে পারব না।
আরেক নারী উদ্যোক্তা বনি হাসান বলেন, অন্যান্য সব ব্যবসায়ীর মতো দেশের হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তার ব্যবসার ওপর নির্ভর করে তাদের নিজেদের এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি। অনেক নারীই দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যে অবদান রেখে জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি। আর এখন সরকার আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত না বাড়ালে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।
উইমেন এন্টারপ্রেনিয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ওয়েব) সভাপতি নাসরিন আউয়াল মিন্টু বলেন, কোভিডের কারণে অন্যান্য ক্ষুদ্র ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মতো নারী উদ্যোক্তাদের ওপরও আঘাত পড়েছে। তারা এখন দিশাহারা। কী করবেন কেউ বুঝতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত নারী উদ্যোক্তাদের ৪ শতাংশ নয়, শূন্য সুদে এক বছরের ঋণ সুবিধা দেওয়া হোক। এই সহায়তা শুধু নারী উদ্যোক্তাদের বাঁচাবে না, অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। রেজা