খেলাপি ঋণ বিষয়ে শক্ত অবস্থান নেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের
মো. আখতারুজ্জামান : প্রতিবছরেই বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। আর এসব হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নেতৃত্বের কারণে। মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরেছে। টিআইবির প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা না দেয়া সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে দিন যত যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আগামীতে আস্থাহীনতায় পরিণত হবে ব্যাংকখাত।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে কিছু পরিবারের হাতে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। কারণ একই পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে ৪ জন পর্যন্ত পরিচালক রাখার বিধান, পরিচালকের মেয়াদ পরপর দুইবারে সর্বোচ্চ ছয় বছরের পরিবর্তে পরপর তিনবারে সর্বোচ্চ নয় বছর থাকার বিধান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে একই পরিবারের চারজন সদস্যের বাইরে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আগে আমরা ব্যাংক খাতের প্রয়োজন আইন সংশোধন করতাম। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যক্তির প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে। কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবারের যাদি ৪ জন সদস্য থাকেন সেখানে এই চার জনের বাহিরে কেউ কথা বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। ফলে এখন ব্যাংকগুলোর পরিবারতান্ত্রিক হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ হবে ব্যাংক ভিত্তিক মনিটরিং করা প্রয়োজন। ঋণ খেলাপি ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
খেলাপি ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল সুযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, নিয়মিত ঋণ গ্রহীতার চেয়ে ইচ্ছেকৃত খেলাপিদের জন্য সহজ শর্ত দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নিয়মিত ঋণ গ্রহীতাকে খেলাপি হতে উৎসাহী করা হল।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগে সরকারের ৪ থেকে ৫টি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ছিলো একটি। এখন সেই অবস্থান নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে ব্যাংকটিতে পেশাদার লোকের অভাব রয়েছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে পেশাদার লোক নিয়োগ দেয়া হতো। এখন খুব বেশি পেশাদার লোকদের নিয়োগ দেয়া হয় না। এসব পদে নিয়োগের বিষয়ে রাজনৈতিক বলয় কাজ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন শুধু কাগজে কলমে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। স্বায়ত্তশাসন চর্চার ঘাটতি রয়েছে।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কাজ করেছে। তাদের মেরুদ- যদি শক্ত হতো তাহলে খেলাপি ঋণের বিষয়ে ভালো অবস্থান নিতে পারতো। ২০১৫ সালে যেসব বড় বড় খেলাপিদের সুযোগ দেয়া হয়েছে আবার তাদেরকে সেই সুযোগ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় অনেকটা উদার শর্তে তাদেরকে সেই সুযোগ দেয়া হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে তো যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তারা সেখানে থেকে বেরিয়ে আসতে তাগিত বোধ করে না। অন্যদিকে যারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি হয় তারাও ভাবছে যে ভালো হয়ে তো লাভ নেই। একটু কৌশল করলে তো আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অবনতি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার যে অভাব রয়েছে বলে টিআইবি বলেছে তাতে আমার কোনো দ্বিমত নেই।
মন্দমানের খেলাপি ঋণের সময়কাল পাঁচ বছরের স্থলে তিন বছরে অবলোপনের সুযোগ এবং শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতির বিধান শিথিল করার কথা উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, খেলাপি ঋণ কাগজে কলমে কম দেখানো, খেলাপি ঋণকে উৎসাহিত করা এবং অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে ব্যাংকের তৎপরতা হ্রাস করা হয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান ধারার বিশ্লেষণের পাশাপাশি সেটির তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিকাঠামো এবং নেতৃত্বের দুর্বলতার নানা দিক তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও পরবর্তীতে খেলাপি ঋণের হার পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০০৯ সালের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর ২০১৯ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। দশ বছরে বৃদ্ধি ৪১৭ শতাংশ। যদিও একই সময়ে মোট ঋণ বৃদ্ধির হার ৩১২ শতাংশ; প্রতি বছরে গড়ে বৃদ্ধি ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। রেজা