কোভিডে সাত মাস উৎপাদন বন্ধে মৌলভীবাজারের আগর শিল্পে ধস
কেএম নাহিদ : মৌলভীবাজারের এ ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি শিল্পে। করোনা মহামারীর কারণে স্থবিরতা নেমে এসেছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না হওয়ায় সীমিত করা হয়েছে কারখানাগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। আগর-আতরের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজারের বড়লেখার আগর চাষের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের। তবে গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে আগর চাষ বিস্তার লাভ করে। পর্যায়ক্রমে তা কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ীসহ বিভিন্ন উপজেলায় বিস্তৃত হয় এবং গড়ে ওঠে আগর-আতর শিল্প।
খাতসংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৫ সালে শিল্প হিসেবে ঘোষণার পর বাণিজ্যিকভাবে আগরের চাষ বেড়েছে এ অঞ্চলে। বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নে প্রায় ২৫০ ছোট ও মাঝারি আগর-আতর কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানে আছে আরো ৫০টির মতো। তবে বন বিভাগের হিসাব মতে, জেলায় নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ১৭৬। এর বাইরেও অনিবন্ধিত কিছু ছোট কারখানা রয়েছে। আগর-আতরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আছেন মৌলভীবাজারের ৪০-৫০ হাজার মানুষ। বড়লেখার সুজানগর ইউনিয়নের সালদিঘা, রফিনগর, হাসিমপুর, চিন্তাপুর, বড়থল গ্রামসহ আশপাশের গ্রাম এবং পাথারিয়ার পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি আগর চাষ হয়। কিন্তু কোভিড-১৯-এর কারণে ধস নেমেছে এ শিল্পে।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারেও দিন দিন চাহিদা বাড়ছিল পণ্যটির। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ওমান, ইয়েমেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে আগর-আতর রপ্তানি হয়। কুয়েত, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের কয়েকটি আগর-আতর কারখানা রয়েছে, যেখানে কাঁচামাল যেত মৌলভীবাজার থেকে। শুধু বড়লেখাতেই বছরে আগরের নির্যাস প্রায় এক হাজার লিটার উৎপাদিত হয়। বিপুল চাহিদা থাকায় আগে যেখানে সরবরাহ দিতে হিমশিম খেতে হতো, এখন সেখানে কোনো পণ্যই বিক্রি হচ্ছে না। এ অবস্থায় শিল্পটি রক্ষায় সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বে অব বেঙ্গল পারফিউমারির স্বত্বাধিকারী কবির আহমদ জানান, তাদের ১০-১২ বিঘা জমিতে আগর বাগান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ৪০ জন মানুষ কাজ করেন। ওই কারখানার ১৬টি মেশিনে মাসে গড়ে ২০০ তোলা (এক তোলায় ১১.৬২ গ্রাম) আতর হয়। প্রতি বছর ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে তাদের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বর্তমানে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে তার ব্যবসা।
করোনায় ব্যবসায় ক্ষতির কথা জানিয়েছেন সুজানগরের ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দুসও। তিনি জানান, করোনা পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা না আসায় তার কারখানায় প্রায় ২ কোটি টাকার আগর-আতর মজুদ পড়ে আছে। সীমিত করা হয়েছে কারখানার কার্যত্রম। বড়লেখার সুজানগর এলাকার অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কারখানা বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, প্রতি মাসে জেলার কারখানাগুলোতে কম করে হলেও ২০০ কেজি আগর কাঠ ও ২৫০ লিটার আতর উৎপাদিত হতো। করোনার কারণে সাত মাস ধরে বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ কারখানা । এ পরিস্থিতিতে শিল্পটি রক্ষায় ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি আনসারুল হক ও সাধারণ সম্পাদক আশরাফ মুহিত ছায়েফ।
এদিকে পরিস্থিতি জানতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি টিম এলাকা পরিদর্শন করেছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৌলভীবাজার ডিসি মীর নাহিদ আহসান। তিনি বলেন, এডিসি (সার্বিক) প্রধান করে গঠিত এ কমিটি ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সূত্র : বণিক বার্তা অনলাইন।