আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ১
জানুয়ারিতে যারা ঋণের কিস্তি দেননি তারা খেলাপি
মো. আখতারুজ্জামান : করোনার ক্ষতির কাটিয়ে উঠতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ গ্রহিতার ঋণের কিস্তি পরিশোধের যে বাধ্যবধকতা ছিলো তা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। ঋণ গ্রহিতাদের চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। যারা জানুয়ারিতে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেননি তারা খেলাপির তালিকায় চলে যাবেন। যদিও বেশ কিছু দিন থেকে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলো। তবে মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারি করে তা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন এতে করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে। ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে গ্রাহকদের করোনাকালীন ঋণের অপরিশোধিত কিস্তি কিভাবে পরিশোধ হবে তার নিয়ম চায় ব্যাংকাররা।
গত বছরে করোনাভাইরাস প্রকোপ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধ না করলেও কোনো গ্রাহক খেলাপি হবেন না, এমনকি ঋণের মানের অবনমন হবে না এই সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে খেলাপি কোনো গ্রাহক ঋণ শোধ করলে তাকে খেলাপিমুক্ত করা যাবে বলেও জানায়। পরে এই সময় বাড়িয়ে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে পুরো এক বছর ঋণ শোধ না করেও ভালো গ্রাহক থাকার সুযোগ দিয়েছি। এতে ঋণ পরিশোধে গ্রাহকেরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। এটা যত দীর্ঘ হবে ততো আগ্রহ হারার তালিকা বড় হবে। ফলে সময় আর বাড়ছে না।
এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, এখনও করোনার প্রভাব রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে করোনা টিকার ওপর। যখন সবাই টিকা নিতে পারবে, তখন ব্যবসা স্বাভাবিক হবে। আমরা এসব বিষয়ে গভর্নরের কাছে চিঠি দিয়ে সময় বাড়ানোর কথা বলেছিলাম।
তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে প্রথম দফায় গত এপ্রিলে ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দফায় জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও ঋণের শ্রেণি-মানে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না বলে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় এ মেয়াদ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং তৃতীয় দফায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। সে হিসাবে আর ক’দিন পরই এ সুযোগ শেষ হচ্ছে। যদিও তার আগে ছাড়ের মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম বলেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় বাড়েনি। তবে বিগত সময়ের কিস্তিগুলো কিভাবে পরিশোধ হবে সেটার কোনো দিকনির্শেনা আসেনি। ফলে আমরা এখন স্বাভাবিক যে কিস্তি হচ্ছে সেটাই নিচ্ছি। তবে খুব শিগগির এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে যে, বিগত সময়ের কিস্তিগুলো গ্রাহকদের কিভাবে পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের ঋণ ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। এ অবস্থায় জানুয়ারি থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধ্যকতা চালু হলে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়তে পারেন। এজন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগ পরিচালকই চাচ্ছেন ঋণের কিস্তি আগামী জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হোক।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। আগামী জুলাই মাসের পর থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। মার্চ থেকেই দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশ ঋণ নতুন করে খেলাপির খাতায় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার মতে, এখন এ সিদ্ধান্তের ফলে খেলাপি ঋণের প্রভাব যেভাবে পড়বে, ছয় মাস পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ব্যাংকগুলোতে ধাক্কা তার চেয়ে একটু কম লাগতো। কোভিডের কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর যে দাবি জানিয়েছেন তা যৌক্তিক। তবে এই সুযোগ ঢালাওভাবে সবাইকে দেওয়া উচিত নয়। আগের সুবিধা অব্যাহত না থাকায় ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাব ও ঋণ বকেয়া স্থিতির পরিমাণ বিবেচনায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কেবল মেয়াদি ঋণ বা বিনিয়োগ হিসাবের অবশিষ্ট মেয়াদের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ সময় বৃদ্ধি করা যাবে। তবে এরূপ বর্ধিত সময়সীমা কোনোভাবেই দুই বছরের বেশি হবে না।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ থেকে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে বিদায়ী বছরের এপ্রিল থেকে তিন দফায় ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতায় স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। তবে ডিসেম্বরে তৃতীয় দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধে শিথিলতার মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়ে গভর্নরকে চিঠি দেওয়া হয়। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও