টেকসই উন্নয়নে পরিবার-পরিকল্পনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যা নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তিকর তথ্য বিভিন্ন জন দিচ্ছেন। কেউ বলছেন ১৬ কোটি, কেউ বলছেন ১৭ কোটি আবার কেউ কেউ বলছেন ১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু প্রকৃত জনসংখ্যা কতো তা জানা যাবে জনগণনা ফলাফল প্রকাশের পর। বিগত গণনা সম্পূর্ণ হয়েছিলো ২০১১ সালে প্রতি ১০ বছর অন্তর এই গণনা অনুষ্ঠিত হয় সুতরাং এ বছর বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য জানা যাবে দেশব্যাপী জনগণনা শেষে। তবে যে বিষয়টি অনেকে স্বীকার করেন তা হচ্ছে দেশে গত একযুগ ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে সমাজে জনবসতি এবং শহরগুলোর জনস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়ে চলছে। এতে সামাজিক সমস্যা, অপরাধ প্রবণতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের আশানুরূপ ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। কারণ আমাদের সমাজে ষাটের দশক থেকে চলে আসা পরিবার-পরিকল্পনা ব্যবস্থাটির ওপর একসময় সরকার যেভাবে গুরুত্বারোপ করেছিলো তাতে বেশ সুফল পাওয়া গেলেও গত কয়েক বছর সেভাবে পরিবার-পরিকল্পনা কার্যক্রম চলছে বলে মনে হয় না।
অপেক্ষাকৃত দরিদ্র, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবার এবং বিশেষ বিশেষ এলাকায় পরিবার-পরিকল্পনা ব্যবস্থাটি এখন আর আগের মতো ক্রিয়াশীল নেই। এ কারণে ওইসব পরিবার ও অঞ্চলে জনসংখ্যা অপরিকল্পিতভাবে বেড়েই চলছে। এর ফলে পরিবারের জনসংখ্যা বাড়ছে, শিশুদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, শিক্ষায় শিশুদের দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য গ্রামাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক ছেলে-মেয়ে পুষ্টির অভাব, প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাব ও দক্ষ জনশক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শহরাঞ্চলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠি এবং সাধারণ আয়ের পরিবারগুলোর সন্তানেরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে না। আমাদের গোটা সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে তরুণদের একটি বড় অংশ কর্মক্ষমতা অর্জন করতে পারছে না।
তাদের মধ্যে অনেকেই বেকার কিংবা নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায়। আবার অস্বচ্ছল পরিবারগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা এখনো ব্যপকভাবে বহাল রয়েছে। এছাড়া যেসব পরিবারে সন্তানের সংখ্যা বেশি, তাদের লেখা পড়ার দায়িত্ব পরিবারগুলো যেহেতু নিতে পারছে না তাই এসব শিশুর একটি বড় অংশ বিভন্ন মাদ্রাসায় থাকা খাওয়া ও পড়ালেখা করার ব্যবস্থার নামে একটি মহল উদ্যোগ নিচ্ছেন। কিন্তু এসব শিশু অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত হওয়ার মতো কোনো শিক্ষা লাভ করতে পারছে না। ফলে দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক কার্মকা-ের সম্ভাবনা তৈরি হলেও মানস্মত শিক্ষা, স্বচ্ছল ও সংস্কার মুক্ত পরিবেশের সুযোগ সেভাবে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশে অপরিকল্পিত ভাবে যেমন জনসংখ্যা বাড়ছে, একইভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান ইত্যাদিও চলছে পরিকল্পনাহীনভাবে। তাছাড়া ২১ শতকের ডিজিটাল প্রযুক্তি ও জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে তালমিলিয়ে নতুন প্রজম্মকে দক্ষ ও সুশিক্ষিত জনশক্তিতে রূপান্তিরিত করার শিক্ষা, শিল্প, প্রশাসনসহ যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এরফলে দেশে টেকশই উন্নয়ন সংগঠিত করার মূল শক্তি হিসেবে জনগণকে চাহিদা মোতাবেক তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশ থেকে লাখ লাখ কম শিক্ষিত অদক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করি তা থেকে আমরা যে রেমিটেন্স পাই তা দিয়ে পরিবারগুলোর স্বচ্ছলতা কিছুটা ফিরলেও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করার মতো অবস্থা তৈরি হচ্ছে না। তাছাড়া রেমিটেন্সের বড় অংশই পরিবারগুলোর স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে, বাড়ি-ঘর নির্মাণ করতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব পরিবার সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষায় দক্ষ করে তোলার মতো ভূমিকা পালন করতে পারে না। এ কারণে দেশে উন্নত শিল্প কলকারখানা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় দক্ষ জনশক্তির অভাব কোনো অবস্থাতেই মেটানো যাচ্ছে না। প্রায় ৫ লাখ বিদেশি দক্ষ জনশক্তি বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন যারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ থেকে নিজেদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। একারণে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে অপরিকল্পিত পরিবার এবং অদক্ষ জনগোষ্ঠীর চাপ যেন আর কোনো অবস্থাতেই বৃদ্ধি না পায়। এটি জাতীয় পরিকল্পনার মধ্যে কঠোরভাবে বিবেচিত থাকতে হবে। লেখক পরিচিতি : শিক্ষাবিদ। অনুলিখন : আব্দুল্লাহ মামুন