আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ২
প্রণোদনার অর্থ যেন পৌঁছায় ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে
ড. নাজনীন আহমেদ
বসন্ত এসেই গেল। গতবছর এ সময়ে ভাবতে পারিনি, আমরা কী ভয়াবহ জীবন ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়তে যাচ্ছি। সে বিপর্যয় শেষ হয়ে গেছে, তা বলা যাবে না। তবু টিকা দেয়া শুরু হওয়াতে স্বস্তি পাচ্ছি মনে যে, আমরা বোধহয় মহাদুর্যোগ পার হয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে গেছে অনেক প্রাণ, অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট হয়েছে, অনেকে চাকরি হারিয়েছেন বা আয় কমে গেছে। আবার অনেকের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে কোভিড। নতুন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমেছেন অনেকে ই-কমার্স, অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। অনলাইন ডেলিভারি সিস্টেমের কারণে তৈরি হয়েছে নতুন উদ্যোক্তা। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যের বাজার প্রসারিত হয়েছে। আগামী এক থেকে দেড় বছর আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ের মধ্যে কোভিড-১৯ এর প্রভাবজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি যেমন পুষিয়ে নিতে হবে, তেমনি অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
করোনার কারণে যাদের ব্যবসা বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ তাদের কাছেই গেছে বা যাবে যারা ব্যাংকের কাছে ভালো ক্লায়েন্ট। আর ব্যাংকের কাছে ভালো ক্লায়েন্ট তো তারাই হবার কথা, যারা ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হননি বা যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দিতে পারবেন। তাই ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা সেই সব উদ্যোক্তার কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যাদের হয়তো ক্ষতি কম হয়েছে। কিংবা তেমন ক্ষতি হয়নি। আবার যেহেতু প্রণোদনার অর্থ মূলত ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, তাই যার ব্যবসা চালু রাখা সম্ভব হয়েছে, তিনি ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল নিবেন। যার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, তিনি এ ঋণ দিয়ে কি করবেন? তাছাড়া রপ্তানি নির্ভর অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার সংকটে ভুগছেন। তাদের পণ্যের জন্য যদি অর্ডার না থাকে, তাহলে তারা ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য আবেদন করবেন না। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য শ্রমিক ছাঁটাই, ব্যবসা বন্ধ ইত্যাদি ছাড়া কোন উপায় নেই। অথচ এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখা খুব দরকার।
তাই প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থনৈতিক কার্যকারিতা বাড়াতে একে নিয়ে যেতে হবে ব্যবসায়, যাদের অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বা যারা আপাতত ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন তাদের কাছে। তাদেরকে কি করে পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রণোদনা প্যাকেজের ভেতরে এ ধরনের সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের উপকার হবে। নইলে প্রণোদনার কম সুদের ঋণ হয়তো যাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত অথবা একেবারেই ক্ষতি হয়নি, এমন উদ্যোক্তার কাছে। আর তারা অল্প সুদে পাওয়া প্রণোদনার সেই টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করবেন না তা কি গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়? টাকার গায়ে তো আর লেখা থাকে না, কোনটা প্রণোদনার অর্থ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কোভিডের সময় কোটিপতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। ধনীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা সমস্যা না। কিন্তু মনের মাঝে মাঝে প্রশ্ন উঁকি দেয়, প্রণোদনার অর্থ নিয়ে কেউ আবার কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করেননি তো! (?) নিশ্চিত করে হ্যাঁ- না কোনটাই বলতে পারবো না। শুধু মনে করি, প্রণোদনার অর্থ তাদের কাছে যেন পৌঁছায়, যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং যারা আবার ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে চান। বসন্তের খুশি খুশি মৌসুমী একটু কঠিন কথা হয়ে গেল। সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা।
লেখক পরিচিত : বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ গবেষক।
সূত্র : ফেসবুক