নিরাপদ খাদ্য সঙ্কটে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
অধ্যাপক ড. শামসুল আলম
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের প্রধান শর্ত পুষ্টি। একসময় গ্রাম-গঞ্জে নানা মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের ফল-মূলে ভরপুর ছিলো। বর্তমানে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, নেতৃত্ব পর্যায় আছেন তারা সকলেই গ্রামে-গঞ্জে বেড়ে উঠেছেন। তারা খেলাধুলা, শারীরিক ও মানসিক সুষম বিকাশের দিক থেকে খাদ্য অভ্যাসের ওপরে শতভাগ নির্ভশীল ছিলেন। বর্তমানে সেই খাদ্য অভ্যাসের ফল-মূল ও খাদ্য উৎপাদন বিদেশি প্রস্তুতকারক কেমিকেলজাত প্রক্রিয়াকরণের ওপর নির্ভর করছে। যে সমস্ত পণ্য, খাদ্যদ্রব্য, ফল-ফলাদি, কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন হচ্ছে সেখানে কীটনাশক সমৃদ্ধ এবং মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহার করা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় নিয়ম মানা হচ্ছে না। তদারকি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাহীনভাবে যেসব খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে সেগুলো নিরাপদ খাদ্য নয়। এ সমস্ত খাদ্যে গুণগতমান কি পরিমাণ থাকতে হবে এবং খাদ্য বিক্রয়ের সময় সে ব্যাপারে জনগণকে সেভাবে সচেতন করা হচ্ছে না।
কোন ধরনের খাদ্যে কী পরিমাণ কেমিকেল ব্যবহার করতে হবে তা নিয়ে কৃষককে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমানে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে আমাদের খাদ্য ব্যাবস্থা চলছে। এ জায়গায় সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে তা যদি নিরাপদ, সুষম, সুষ্ঠু, শিশুদের মেধা বিকাশে সহায়ক খাদ্য এবং সু-স্বাস্থ্য জাতি গঠনে পরিকল্পতভাবে ব্যবহার করতো, সেটি অনেক বেশি সৌভাগ্যের বিষয় হতো। সরকার যে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে, এই অর্থ খরচ করে কীভাবে বিকশিত মেধাসম্পন্ন, স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ জাতি তৈরি করা যাদের দায়িত্ব তাদের সেই সক্ষমতা নেই।
প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই এ বিষয়গুলো নিয়ে সক্ষমতাহীন ও ঘুষ-দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত বটে, যার জন্য তাদের কোনো সক্ষমতা নেই। এই সম্পর্কে তাদের যে জ্ঞান থাকা দরকার সেটিও দৃশ্যমান নয়। তারা সবকিছুর জন্য আমদানিকৃত বিদেশি পণ্যমুখী। পরবর্তী প্রজন্ম সহায়ক সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে অবদান রাখবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে এবং তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সরকারে সদিচ্ছার কথা বলা হলেও যারা দায়িত্বে রয়েছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকর কোনো পদক্ষেপ বা ফলপ্রসূ কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সচেতনতা ও তদারকি বেড়েছে, তবে খাদ্যের নিরাপত্তা এখনো অনিশ্চিতায় রয়েছে।
সকলে কেবল খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগী কিন্তু খাদ্যের পুষ্টি, গুণগত মান ও নিরাপত্তা তেমন গুরুত্ব পায় না। পৃথিবীতে এখন কোনো কিছু আর অজানা নেই, পৃথিবী এখন উন্মুক্ত, গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। সেখানে এই সমস্ত বিষয়গুলো যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে, সেখানে আমাদের অবস্থান খবুই নি¤œমানের। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের জাতীয় সমস্যায় যেভাবে স্পর্শকাতর ভাবে দেখে, সেখানে আমরা একদম ভিন্নভাবে দেখি এবং তা নিয়ে মাথা ঘামাই না বললেই চলে। আমরা কী মানের খাদ্য উৎপাদন করছি। সেই খাদ্য আমাদের জাতিগঠন, মেধা বিকাশ, স্বাস্থ্যবান-সুস্থ জাতি গঠনে এসব খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া আদৌ উপযোগী কি। ক্ষতিকারক কি। সে বিচার বিবেচনা কি আমাদের আছে।
প্রকৃতির নিয়মে আমরা বেড়ে ওঠেছিলাম। আষাঢ়, শ্রাবণ, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত ঋতুতে নানা ধরনের ফল-মূল খেয়ে বেড়ে ওঠেছিলো বাচ্চা, ছেলে-মেয়েরা। এ ধরনের ফল প্রায় প্রত্যেকের বাড়ির আঙিনায় পাওয়া যেতো। এসব আমরা লালন-পালন না করে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ফল-মূলে বাজার ভরে ফেলেছি। অথচ ওই সময় ফল কিনে খাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমাদের ছিলো না।
এখন আমরা ফলের বাজার তৈরি করেছি, কিন্তু আমাদের দেশের আদি ফল, জাতীয় ফল, বৈশিষ্টমন্ডিত ফলকে আমরা বিদায় করেছি। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা বিস্তার করতে গিয়ে আমরা এ ধরনের ফল থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা খাদ্য রপ্তানি করার ক্ষমতা রাখি, অথচ আমরা চাল আমদানি করার সুযোগ দিই। কোন পণ্য আমাদের আমদানির জন্য সহায়ক। কোন পণ্য রপ্তানির জন্য সহায়ক। কোন বাজার আমদানির জন্য ছেড়ে দিতে হবে। কোন বাজারে পণ্য রপ্তানির জন্য ধরতে হবে। এগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট জাতীয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিকল্পনা এবং পলিসি থাকতে হবে।
পরিচিতি : উপদেষ্টা, কনজুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। অনুলেখক : আব্দুল্লাহ মামুন