লাভজনক হওয়ায় ধানের জমি আম বাগানে রূপান্তরিত হচ্ছে
মতিনুজ্জামান মিটু : ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক গুণ বেড়েছে। দেশীয় ফলের সাথে সাথে বিদেশি ফলসমূহ দেশের চাহিদা পূরণে ভ‚মিকা রাখছে। এদেশের মানুষের সবচেয়ে পছন্দনীয় ফল হলো আম। সারা বছর চাহিদানুযায়ী ফল খেতে না পেলেও আমের মৌসুমে সাধ্যমতো পুষিয়ে নেন ভোক্তারা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফ উদ্দিন জানান, চলতি মৌসুমে আমের বোল কেমন হয়েছে ও ফলন কেমন হবে তা এখনই বলার সময় আসেনি। তবে বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে আমের উৎপাদন বাড়ছে। এ চাহিদা পূরণে ২৩টি জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ স¤প্রসারণ হয়েছে। তবে অন্য জেলাগুলোতেও আমের উৎপাদন বাড়ছে। তারপরও নতুন বাগান স্থাপনে থেমে নেই জমির মালিক ও আম চাষিরা।
বিগত কয়েক বছরে সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় আম চাষ স¤প্রসারিত হলেও নওগাঁ জেলায় সবচেয়ে বেশি আম বাগানের স¤প্রসারণ হয়েছে। ধানের চেয়ে তুলনামূলক লাভজনক হওয়ায় প্রথমে ধানের জমিতে আমগাছ লাগানো শুরু করেছেন। এরপর তা শুধু আম বাগানে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ জেলার সবচেয়ে বেশি আম বাগান স¤প্রসারিত হয়েছে পোরশা ও সাপাহার উপজেলায়।
এ জেলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বারি আম-৩ তথা আ¤্রপালি জাতের এবং এরপরের স্থান বারি আম-৪। অন্য জাতগুলোও কম পরিমাণে চাষ করতে দেখা যায়। সব মানুষের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে, বারি আম-৩ জাত বা আ¤্রপালি সম্পর্কে। অনেকের ধারণা গাছটি আকারে বড় হয় না এবং বেশি বছর বাঁচে না। এ ধারণাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫ বছর বয়সের গাছ রয়েছে এবং এ গাছগুলোর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ফল ধারণক্ষমতা বাড়ছে। এ জাতের গাছ বেশি বড় হয় না, তাই চাষিরা অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান রোপন করেন।
পোরশা, সাপাহার, নাচোল, গোমস্তাপুর উপজেলার অনেক আম বাগান সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, নতুন বাগানগুলো আমগাছ রোপণের সাধারণ দূরত্ব অনুসরণ না করে ঘন ও অতি ঘন পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। সেক্ষেত্রে প্রতি হেক্টর জমিতে ১২০০ থেকে ১৭০০ পর্যন্ত আমের কলম রোপণ করছেন। ফলে গাছ রোপণের ৩-৪ বছরের মধ্যেই একটি গাছ অন্য গাছের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কোনো কোনো চাষি আম সংগ্রহ করার পর প্রæনিং, ট্রেনিং করে গাছগুলোকে ছোট রাখার চেষ্টা করেছেন। তবে অধিকাংশ চাষিকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এসব আম বাগানে ২-৩ বছরের মধ্যে ভালো ফলন পাওয়ার পরিবর্তে ফলন কমার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান করলে আম বাগান ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। আম গবেষক ও আম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এ সব চাষিদের এ মুহ‚র্তে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, অল্প সময়ে ফলের চাহিদা মেটাতে ও আমের ফলন বাড়াতে এ ধরনের উদ্যোগ যুক্তিসংগত কিন্তু সঠিক নিয়মকানুন না জেনে অতিঘন পদ্ধতিতে আম বাগান করলে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
স্বাধীন হওয়ার আগে যে আম বাগানগুলো দেখা যায়, সেগুলো কমপক্ষে ৩০ দ্ধ ৩০ ফুট দূরত্বে অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে ১০০টি কলম লাগানো হতো তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ৪০ দ্ধ ৪০ ফুট দূরত্বের বাগানও দেখতে পাওয়া যায়। অনেক বড় আম বাগানে এক বিঘা জমিতে একটি বা দুইটি আমগাছ দেখা যায়। ১৯৮৫ সালে আম গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর বড় জাতগুলোর জন্য ৩০ দ্ধ ৩০ ফুট (প্রতি হেক্টরে ১০০টি গাছ) এবং ছোট জাতগুলোর জন্য ১২ থেকে ১৮ ফুট (৬২৫টি হতে ৫৫৫টি গাছ প্রতি হেক্টরে) দূরত্বে লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হতো। ফলে ১০-১২ বছর অনায়াসে আম বাগানে অন্য ফসল চাষ ও আমের ফলন পেতে তেমনটি অসুবিধা হতো না। এরপর চালু হলো দুইটি বড় জাতের গাছের মধ্যে একটি ছোট জাতের গাছ লাগানো এবং ১০-১২ বছর পরে বড় গাছের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু হলে মাঝের গাছটি কেটে ফেলার পরামর্শ দেয়া হতো। তবে অনেকে মাঝের ছোট গাছটি কাটতে চাইতেন না।
ফলে উভয় গাছের ফলন বাধাগ্রস্ত হতো এবং রোগ ও পোকার আক্রমণের কারণে ভালো আম উৎপাদন করা সম্ভব হতো না। আর অতি ঘন পদ্ধতিতে লাইন হতে লাইন ৩ মিটার এবং গাছ থেকে গাছ ২ মিটার দেয়া হয়। ফলে এক হেক্টর জমিতে ১৬৬৭টি গাছ লাগানো হয়ে থাকে। এ বিশাল চাহিদাপূরণে এ এলাকায় গড়ে উঠেছে শত শত নার্সারি, যেখানে গুণগত মানসম্পন্ন কলম উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তবে কেউ কেউ ৩ মি.দ্ধ ৩ মি. অথবা ৪ মি. দ্ধ ৩মি. দূরত্বে আম বাগান করছেন। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে নার্সারি মালিকরা জমির মালিককে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, যত গাছ তত আম। অপরপক্ষে আম গবেষকরা এবং আম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এখন অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপনে পরামর্শ দেন না, কারণ দেশে সবাই জানেন, একবার আমগাছ লাগালে ৩০ থেকে ৪০ বছর অনায়াসে আম উৎপাদন ও বিক্রয় করা যাবে।
এমনও অনেক চাষি আছে, যারা শুধুমাত্র আমের মৌসুমে বাগানে গমন করেন এবং বছরের অন্যান্য সময় আম বাগানে যাওয়ার দরকার মনে করেন না। তবে বেশির ভাগ চাষি আম বাগানে শুধুমাত্র সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু অতি ঘন পদ্ধতির আম বাগানে ১২ মাস বাগান পরিচর্যার দরকার হয়। সময়মতো সার দেওয়া, সেচ দেওয়া, প্রæনিং, ট্রেনিং ও মরা ডালপালা অপসারণসহ দরকারি অন্যান্য কাজ করতে হয়। যদি কোনো চাষি গাছ লাগানোর পর তিন বছর প্রæনিং না করে থাকেন, তাহলে পরের বছরে আমের ফলন বাড়ার পরিবর্তে কমার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে সঠিক জাত নির্বাচন করে অতি ঘন এবং ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপন করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও, রেজা